ফরিদপুর প্রাচীন একটা শহর। এই শহরের দেয়ালে এখনও খুব একটা লাগেনি জাঁকজমক শহুরে রং। প্রাচীন এই শহরে জন্ম নিয়েছেন অনেক গুণীজন। যার মধ্যে অন্যতম একজন পল্লী কবি জসীমউদদীন।
১৯০৪ সালে জেলার তাম্বুলখানা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। শহর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গ্রাম। যেতে যেতেই মনকে আচ্ছন্ন করে গ্রাম্য স্নিগ্ধ ভালোলাগার আবেশ। গ্রাম্য ছোঁয়ার সাথে সবুজের হাতছানি মনে করিয়ে দেয় এটা পল্লী কবির গ্রাম। কবি তাঁর কবিতার ভাষায় প্রকৃতির মায়ায় ভরা ছোট সে গাঁয়ে সকলকে নিমন্ত্রণ জানান-
‘তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়/ গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়;/ মায়া মমতায় জড়াজড়ি করি মোর গেহখানি রহিয়াছে ভরি,/ মায়ের বুকেতে, বোনের আদরে, ভায়ের স্নেহের ছায়,/ তুমি যাবে ভাই- যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়।
পল্লী কবির নিমন্ত্রণ বলে কথা! তাঁর নিমন্ত্রণ রাখতে অনেকেই আসেন এ গাঁয়। কবি বাড়ির সামনে নামতেই চোখে পড়বে একটা ছোট নদী। নাম কুমারখালী। তার পাশেই একটা বড় মাঠ। এই মাঠে প্রতি বছর শীতকালে বসে কবির স্মরণে‘জসীম মেলা’। ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলার মানুষদের কাছে এই মেলা অত্যন্ত আকর্ষনীয়।
কবির সেজ ভাইয়ের ঘরের সামনে টানানো আছে তাঁর আরেক অনবদ্য সৃষ্টি ‘আসমানী’ কবিতা। কবিতার পাশেই ‘আসমানী’র ছবি।
আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,/ রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।/ বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,/ একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়গড়িয়ে পড়ে পানি।/ একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,/ তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
আসমানী চরিত্রে মধ্য দিয়ে কবি গ্রাম বাংলার সহজ সরল মানুষগুলোর জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন। কবিতাটি ১৯৪৯ সালে ‘এক পয়সার বাঁশি’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়। আসমানী কবির কল্পিত চরিত্র নয়। কবির দেখা বাস্তব চরিত্র। বাস্তবকে তিনি কবিতায় রুপ দিয়েছেন।
কবির ঘরের পাশেই তার আরেকটি সৃষ্টি ‘আমার মা’ গল্পের সত্যিকার রূপ। তার মায়ের ব্যবহৃত ঢেঁকির দেখা মিলে এই ঘরে।
বাড়িটি বহু বিখ্যাত ব্যক্তিদের পায়ের ধূলায় সিক্ত। ১৯২৫ সালে বঙ্গ সাহিত্যের প্রাদেশিক সম্মেলনের পর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবাড়িতে আসেন । এছাড়াও চিত্তরঞ্জন দাস এসেছিলেন এবাড়িতে।
বাড়ির পিছনে আছে নির্মানাধীন পল্লী কবি জসীমউদদীন সংগ্রহশালা। যার ভিত্তি প্রস্থর স্থাপিত হয়েছে ২০১১ সালের ২১ জানুয়ারি। কিন্তু এখনো তা জনসাধারনের জন্য উন্মুক্ত করা হয় নি। শিঘ্রই উন্মুক্ত করে দেয়া হবে বলে জানা যায়। নিঃসন্দেহে সংগ্রহশালা বাড়িটিতে যোগ করবে এক নতুন মাত্রা।
জসীম বাড়িতে কাটানো পুরোটা মুহূর্ত আপনাকে ধরে রাখবে পল্লীর আদি অকৃত্তিম মায়ায়। ফিরে যাবার সময় কেমন একটা শূন্যতা আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। যেতে ইচ্ছে না করলেও ফিরে যেতে হবে। কিন্তু পল্লী কবির সৃষ্টিরা আপনাকে আবারো নিমন্ত্রণ করে রাখবে ফিরে আসার। যেতে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন, আপনি মায়ায় পড়ে গেছেন,পল্লী জননীর মায়ায়, এ মায়ার বাঁধনে আপনাকে বাঁধার সবটুকু উপাদান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে জসীম বাড়ি।