বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের একটি উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট। প্রাচীন সমতটের এই জনপদের সমৃদ্ধির ইতিহাস উপমহাদেশের বহু প্রাচীন জনপদের সমকালীন ও সমপর্যায়ের।
বর্তমানে খুলনা বিভাগের অন্তর্গত বাগেরহাট শহরের পূর্ব নাম ছিল ‘খলিফাতাবাদ’।
ইউনেসকো ঘোষিত বাংলাদেশে যে তিনটি বিশ্ব ঐতিহ্য স্থান রয়েছে, তার দুটির গর্বিত অবস্থান এই বাগেরহাটে। এর একটি হচ্ছে – ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদসহ খানজাহান (রহ:) এর কীর্তি, অন্যটি প্রকৃতির অপার বিষ্ময় সুন্দরবন।
অনেকে কেবল মাত্র ষাটগম্বুজ মসজিদকেই বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান মনে করলেও প্রকৃত পক্ষে খানজাহান আমলে তার দ্বারা নির্মিত মসজিদসহ পুরো শহরটিই জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা (ইউনেসকো) ১৯৮৩ সালে বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসাবে তালিকাভুক্ত করে।
বাগেরহাটকে বলা হয় ‘ঐতিহাসিক মসজিদের নগরী’। যা বর্তমানে সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।
মধ্যযুগে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শণগুলোর জন্য বাগেরহাট নামটির সঙ্গে সব সময় মিশে থাকবে হযরত খান জাহান (রহ:) এর (খান উল আযম উলুঘ খান-ই-জাহান) স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় কীর্তি।
বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি শহরের তালিকায় (ফোর্বস) রয়েছে এই জেলার নাম। খুলনা থেকে ১৫ মাইল দক্ষিণ পূর্ব দিকে এবং ঢাকা থেকে ২০০ মাইল দক্ষিণ পশ্চিশে বাগেরহাট জেলার অবস্থান।
বাগেরহাট জেলার আর এক বড় অংশ জুড়েই রয়েছে আরেক বিশ্ব ঐতিহ্য, পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। করমজল, দুবলারচর, কচিখালীসহ সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পট এ জেলার অন্তর্গত। বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মংলা সমুদ্র বন্দরও এই জেলায়। আর পুরো জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ অনেক পুরাকীর্তি।
বাগেরহাট-এর ইতিহাস–
এদের আগের নাম চণ্ডাল। ইতিহাসবিদদের মতে, তারা বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেন। এছাড়া বাগেরহাটে এক শ্রেণীর মৎস্য শিকারি বা জেলে বসবাস করে, যাদের আদিপুরুষ নিগ্রোবটু (নিগ্রয়েড)। এরা ভারত উপমহাদেশের আদিমতম অধিবাসী। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মধ্য এশিয়া থেকে এ অঞ্চলে আর্য তথা আদি নর্কিভ বা ইন্ডিভদের আগমন ঘটে।
বাগেরহাটের অতিপ্রাচীন স্থান পানিঘাটে প্রাপ্ত কষ্টিপাথরের অষ্টাদশভুজা দেবীমূর্তি, মরগা খালের তীরে খান জাহান (র.) পাথরভর্তি জাহাজ ভেড়ার স্থান জাহাজঘাটায় মাটিতে গ্রোথিত পাথরে উত্কীর্ণ অষ্টাদশভুজা মহিষ মর্দিনী দেবীমূর্তি, চিতলমারী উপজেলাধীন খরমখালি গ্রামে পাওয়া কৃষ্ণপ্রস্তরের বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি নিদর্শন এখানে হিন্দু সভ্যতার পরিচয় বহন করে।
বলা হয়, ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে হযরত খান জাহান (র:) খানজাহানের দীঘি (খানজাহান + আলী > খাঞ্জেলি দীঘি) খনন করান। এ সময় অনন্য সাধারণ ধ্যানী বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে বৌদ্ধ পুরোহিত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো পাল আমলে নির্মিত ঐ বৌদ্ধমূর্তিটি কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারে সংস্থাপন করেন। যা এ অঞ্চলে বৌদ্ধ প্রভাবের পরিচয় বহন করে। এই বৌদ্ধ মূর্তিটি একটি আবক্ষ (আনন্দিত) মূর্তি।
জেলা হিসেবে বাগেরহাট:
ইংরেজদের অধিকারে আসার পর, এই অঞ্চল প্রথমে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটিশ শাসনে চলে যায়। ১৭৮৬ খ্রিষ্টাব্দে লর্ড কর্ণওয়ালিসের শাসন আমলে যশোরকে জেলায় পরিণত করা হয়। ১৮৪২ সাল পর্যন্ত খুলনা ছিল যশোর জেলার একটি মহকুমা এবং বাগেরহাট ছিল খুলনা মহকুমার অন্তর্গত একটি থানা।
সেই সংঘর্ষের কারণেই তিনি প্রশাসনিক প্রয়োজনে বাগেরহাটে একটি মহকুমা স্থাপন করার সুপারিশ করেন। এই সুপারিশের সূত্রে ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট যশোর জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমায় রূপান্তরিত হয়। ১৮৮২ সালে খুলনা, সাতক্ষিরা ও বাগেরহাট মহকুমা নিয়ে গঠিত হয় খুলনা জেলা।
আর বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী বাগেরহাট জেলা হিসেবে উন্নীত হয়।
বাগেরহাট জেলা সাধারণ তথ্যঃ
- অবস্থান : ২২°- ৩২¢ থেকে ২২°- ৫৬¢ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°- ৩২¢ থেকে ৮৯°- ৪৮¢ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ
- আয়তন: ৩,৯৫৯.১১ বর্গকিলোমিটার।
- পৌরসভা: ৩টি। বাগেরহাট পৌরসভা (বাগেরহাট সদর), মোংলা পোর্ট পৌরসভা (মোংলা) এবং মোড়েলগঞ্জ পৌরসভা (মোড়েলগঞ্জ)
- জেলায় মোট ইউনিয়নের: সংখ্যা ৭৫টি।
- গ্রামের সংখ্যা : ১,০৪৭ টি।
- নদ-নদী সংখ্যা: ৩২ টি।
প্রশাসনিক এলাকাসমূহ
প্রশাসনিকভাবে বাগেরহাট জেলা মোট ৯টি উপজেলায় বিভক্ত। এগুলো হলো:
- বাগেরহাট সদর
- মংলা
- মোরেলগঞ্জ
- চিতলমারী
- কচুয়া
- রামপাল
- ফকিরহাট
- মোল্লাহাট
- শরণখোলা
বাগেরহাটের অন্যতম দর্শনীয় স্থান সমুহ:
- ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ
- সুন্দরবন
- খানজাহানের দীঘি
- অযোধ্যা মঠ/কোদলা মঠ
- ইট-নির্মিত খান জাহানের প্রাচীন রাস্তা ও সেতু
- রেজা খোদা মসজিদ
- জিন্দা পীর মসজিদ
- ঠান্ডা পীর মসজিদ
- সিংগাইর মসজিদ
- বিবি বেগুনি মসজিদ
- চুনাখোলা মসজিদ
- নয় গম্বুজ মসজিদ
- রণবিজয়পুর/দরিয়া খাঁ’র মসজিদ
- দশ গম্বুজ মসজিদ
- মংলা বন্দর
- সুন্দরবন-এর করমজল
Support Context:
- যশোহর খুলনার ইতিহাস – সতীশ চন্দ্র মিত্র
- বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর
- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
- বিবর্তিত বাগেরহাট – মোহাম্মদ রেজওয়ানউল হক
- উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া