আহাদ উদ্দিন হায়দার । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বাগেরহাটবাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিলো মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণের বৃহত্তর স্বার্থে এই ‘ডাকবাংলো ঘাট বধ্যভূমি’স্থলে একটি উপযুক্ত স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার। এজন্য প্রগতিশীল ও নাগরিক উদ্যোগগুলো গত ২০ বছর ধরে তাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
শহরের পুরাতন ডাকবাংলো সংলগ্ন ভৈরব নদের তীরে তৎকালীন ডাকবাংলো ঘাটে মুক্তিযুদ্ধকালীন জেলার সব থেকে বড় এই গণহত্যাস্থলটি অবস্থিত।
১৯৯৭ সালে প্রগতিশীল নাগরিক উদ্যোগে এখানে (ডাকবাংলো ঘাটে) একটি বধ্যভূমি বেদি স্থাপন করা হয়। এর ফলক উন্মোচন করেন ১৯৭১ সালে বাগেরহাট মহকুমা অাওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক, শহীদ অজিয়ার রহমানের মা শহীদ জননী জেলাপজান বিবি। কিন্তু অনেক দেন দরবার, রাজণৈতিক লবিং, নাগরিক প্রচেষ্টার পরেও তা পূর্ণাঙ্গতা লাভ করেনি।
এ বছর রাষ্ট্রীয়ভাবে দেশব্যাপি গণহত্যা দিবস পালনের সিদ্ধান্তে অাজ ২৫ মার্চ সকালে জেলা প্রশাসন প্রচলিত অভ্যস্ততায় ডাকবাংলোর পাশে নির্মিত বুদ্ধিজীবি স্মৃতি স্তম্ভে পুষ্পমাল্য প্রদানের অায়োজন শুরু করে। সরকারি পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা বেদি পরিস্কার, ব্যানার ও মাইক লাগানো শুরু করেন। এসময় অামি সেখানে উপস্থিত, সাংবাদিক সহকর্মীসহ জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের কয়েক কর্মকর্তার কাছে প্রশ্ন রাখি যে শ্রদ্ধা নিবেদন কী একটি না দুটি বেদিতেই হবে?
এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত প্রদানের জন্য বিষষয়টি বাগেরহাটের জেলা প্রশাসককে জানানো হয়। তিনি বাগেরহাট-২ আসনের এমপি মীর শওকাত অালী বাদশার কাছে সিদ্ধান্ত জানতে চান। তখন আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। এমপি মহোদয় ডাকবাংলো ঘাটে প্রদানের পক্ষে মত দেন। অামিও একই মত দিলে এমপি ডিসিকে বলেন, সাংবাদিকরাও চায় নদীর পাড়ের বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদন হোক।
এর পর জেলা অাওয়ামীলীগ সভাপতি ডা. মোজাম্মেল হোসেনকে বিষয়টি জানানো হয় এবং সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়।
মুক্তযুদ্ধকালীন গণহত্যা নিয়ে প্রকাশিত ও সংরক্ষিত সব ধরণের বই-পুস্তক দলিল দস্তাবেজ ও নথিপত্রে এই বধ্যভূমির তথ্য স্বীকৃত। ধারণা করা হয়, ৭১ এর পুরোটা সময় জুড়ে এখানে সব মিলে দেড় থেকে দু’হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও নিরিহ বাঙালীকে হত্যা করা হয়েছিলো।
এছাড়া জেলার বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা অসংখ্য গণহত্যাস্থলের মধ্যে রয়েছে বাগেরহাট সদরের রঞ্জিতপুর, মুক্ষাইট, কচুয়ার শাখারিকাঠি, রামপালের ডাকরা প্রভৃতি।
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রায় পুরোটা সময় জুড়েই বাগেরহাটে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর স্থায়ী কোন ঘাঁটি ছিলো না। জামায়াত নেতা মাওলানা ইউসুফ প্রতিষ্ঠিত রাজাকার বাহিনীর খুলনা অঞ্চলের কমাণ্ডার ছিলেন ফকির বংশ নামে পরিচিত বাগেরহাট হযরত খান জাহান (র:) এর মাজারের খাদেমকুলের সে সময়ের সবচেয়ে ক্ষমতাধর নেতা রজব অালী ফকির। তার নেতৃত্বে রাজাকার, আলবদররা বাগেরহাটে পাকসেনাদের প্রতিনিধিত্ব করতো।
কসাইখানার এই দায়িত্ব পালন করে অাতংকের নায়ক হয়ে ওঠেন আকিজ উদ্দিন, কাশেম মাস্টার, সিরাজ মাস্টার গং।
তখন বয়োবৃদ্ধ আকিজ উদ্দিন বড় ছোরা হাতে হত্যার জন্য অানা মানুষটিকে কটাক্ষের সুরে অনুরোধ করতেন, “দেখি, মাথাটা নামা। অামি বয়স্ক মানুষ, তুই সোজা হয়ে থাকলে অামার ছুরি চালাতে কষ্ট হয়।”
সিরাজ মাস্টারের নামে প্রবাদ ছিলো, “তিনি সকালে তিন-চারটে মানুষ জবাই না করে নাস্তা করতেন না।”
বাগেরহাটে রাজাকারদের পতনের পর ১৭ ডিসেম্বর বিকেলে ষাট গম্বুজ এলাকার একটি বাগান থেকে মুক্তযোদ্ধারা রজব অালী ফকিরের মৃতদেহ উদ্ধার করে। বলা হয়, তিনি আত্মসমর্পনকে অপমানজনক বিশ্বাস করে ‘অাত্মহত্যা’ করেছিলেন।
বিস্ময়কর সত্য যে, এধরণের গণহত্যাকারী সিরাজ- আকিজ গংরা ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাগেরহাটে রাজাকারদের অাত্মসমর্পনের পর মুক্তযোদ্ধাদের হাতে অাটক হলেও তাদের উপর একটি ফুলের টোকাও পড়তে দেয়া হয়নি। যার পর নাই নিরাপত্তা দিয়ে তাদের প্রথমে শহরের এসি লাহা মিলনায়তন কক্ষে এবং পরে তৎকালীন টাউন স্কুলে আটক রাখা হয় এবং কারাগারে পাঠানো হয়।
পরে তারা কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং মাথা উুঁচু করে বাগেরহাট শহরে সব ধরণের নাগরিক সুবিধাসহ প্রকাশ্যে বসবাস করেন।
সেদিন কারা কেন তাদের প্রতি এভাবে সদয় হয়েছিলেন সে সত্য খুঁজে দেখার সময় অাজও শেষ হয়নি। বর্তমান সরকারের সময়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ শুরু না হলে, বাগেরহাটের গণহত্যাকারী সিরাজ মাস্টার, কাশেম মাস্টারদের বিচারের অাওতায় আনা সম্ভব হতো না। বিচার শেষ হবার অাগেই কাশেম মাস্টার মারা গেছেন, সিরাজ মাস্টার কারাগারে।
এইচ/এসআই/বিআই/২৫ মার্চ, ২০১৭