সুন্দরবনের পাশে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, অবৈধ নৌপথ ও কয়লার ডিপো নিয়ে জাতিসংঘের ‘রামসার’ সচিবালয় উদ্বেগ জানিয়েছে।
রামসার চুক্তি স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের কাছে এই তিনটি প্রকল্পের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়েছে। জবাবে সরকার তার অবস্থান ব্যাখ্যা করে রামসার সচিবালয়ের কাছে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন), বন বিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তর এ ব্যাপারে যে সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছে, তা রামসার সচিবালয়ে পাঠানো হয়েছে গত ১ আগস্ট। রামসার ইরানের একটি শহর। জীববৈচিত্র্যপূর্ণ জলাভূমি রক্ষায় ১৯৭২ সালে এই শহরে যে চুক্তি সই হয়, তা রামসার চুক্তি নামে পরিচিত।
এর মধ্যে বন বিভাগ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে নির্গত হওয়া উত্তপ্ত পানি, উড়ন্ত ছাই ও দূষণের ব্যাপারে তাদের উদ্বেগ তুলে ধরেছে। আইইউসিএন থেকে রামপাল প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার যথার্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবে পরিবেশ অধিদপ্তর এবং বন বিভাগ উভয়ই অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রয়োজনে এই প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেছে তাদের প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশের সুন্দরবন এবং টাঙ্গুয়ার হাওর রামসার এলাকা বা বিশ্বের জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকার স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ওই চুক্তি লঙ্ঘন করেছে, এমন প্রমাণ পাওয়া গেলে সুন্দরবন রামসার এলাকার সম্মান হারাবে। ১৯৭২ সালে রামসার শহরে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ওই চুক্তিতে এমন শর্তই জুড়ে দেওয়া হয়েছিল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পরিবেশ ও বনমন্ত্রী আনোয়ার হোসেন বলেন, রামপাল প্রকল্পের কারণে যাতে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি না হয়, সে জন্য সরকার পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে অবৈধ নৌপথ সম্পর্কে তিনি বলেন, ইতিমধ্যে সুন্দরবনের বাইরে দিয়ে একটি নৌপথ সৃষ্টির জন্য প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। একটি বিকল্প খাল খনন করে সেখান দিয়ে নৌযান চলাচলের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশ রামসার চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ। ফলে এই চুক্তি অনুযায়ী তারা সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষায় বাধ্য। তাই সরকারের উচিত সুন্দরবনের স্বার্থে রামপাল প্রকল্প বাতিল করা।
রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে বন বিভাগের দুই পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে সম্ভাব্য তিনটি ক্ষতির কথা তুলে ধরা হয়েছে। এর আগে ২০১২ সালের ২২ জুন রামসার সচিবালয় থেকে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র, সুন্দরবনের পাশে জয়মণি গ্রামে খাদ্য বিভাগের বড় গুদাম বা সাইলো নির্মাণ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল। বন বিভাগ থেকে সে সময় এই দুটি প্রকল্প সম্পর্কেই আপত্তি তোলা হয়েছিল। সাম্প্রতিক প্রতিবেদনেও বন বিভাগ থেকে একই ধরনের উদ্বেগ তুলে ধরা হয়।
রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণকারী সংস্থা বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী পাওয়ার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বিজয় শংকর তাম্রকার রামসার কর্তৃপক্ষের উদ্বেগ এবং বন বিভাগের বিশ্লেষণকে অমূলক হিসেবে চিহ্নিত করে প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রকল্প নির্মিত হলে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি তো হবেই না, বরং বনের পরিবেশ আগের চেয়ে আরও ভালো হবে।
গরম পানি বর্জ্য মিশবে: প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে গরম পানি বর্জ্য হিসেবে নির্গত হবে, তা সুন্দরবনের পানির সঙ্গে মিশবে। এতে সুন্দরবনসংলগ্ন নদীগুলোতে বসবাসকারী প্রাণী ও উদ্ভিদ কণারা বাঁচতে পারবে না। সুন্দরবনের বিপুল মাছ, পাখি ও বন্য প্রাণী এই প্রাণী ও উদ্ভিদ কণা খেয়ে বেঁচে থাকে। এর ফলে সুন্দরবনের নদীগুলোতে বসবাসকারী ডলফিনদের বিচরণও বাধাগ্রস্ত হবে।
উন্মুক্ত স্থানে কয়লা মজুত ও পরিবহন: রামপাল প্রকল্পের জন্য সুন্দরবনের ভেতরে পশুর নদী দিয়ে কয়লা পরিবহন করা হবে। বন বিভাগের প্রতিবেদনে উন্মুক্তভাবে কয়লা পরিবহনের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়ে বলা হয়েছে, এতে বিপুল পরিমাণে নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড ও মারকারি নিঃসরিত হবে। এই তিনটি পদার্থ বাতাসে মিশলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় অ্যাসিড বৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে সেখানকার জীববৈচিত্র্য এবং আশপাশে বসতি গড়া মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে।
১৯৯৫ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ আইনে এবং পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালায় পরিবেশগত প্রভাবকে গ্রহণযোগ্য মাত্রায় নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নেতিবাচক প্রভাব সত্ত্বেও এই প্রকল্প বাংলাদেশের অবকাঠামোগত, অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এটি সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।
বিশ্বের ১৬০টি দেশের এক হাজার ৯৭০টি প্রাকৃতিক জলাভূমি ‘রামসার এলাকা’ হিসেবে চিহ্নিত। ১৯৭২ সালে ইরানের রামসার শহরে একটি সম্মেলনের পর বিভিন্ন দেশ এ চুক্তিতে সই করে।
সূত্র- দৈনিক প্রথম আলো ( ।