বনজীবীদের ভাষ্য অনুযায়ী সুন্দরবনের অপরাধের মূল প্রতিপালক বন বিভাগ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী।
দস্যুতা বা বনজ সম্পদ পাচার সবই তাদের মদদ ও সহযোগিতায়। ফলে দস্যু বাহিনীগুলোর হাতে জিম্মি বনের উপর নির্ভরশীল ৭ লাখ পরিবার।
এ কথা মেনেনিয়েছেন একাধিক বনদস্যু। নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বীকার করেছে বনবিভাগের প্রশাসনের মধ্যমসারির এক কর্তা ব্যক্তিও। তবে তারা এ জন্য তার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করেছেন।
সুন্দরবনের বনবিভাগের দায়িত্বে থাকা মধ্যমসারির এক এক কর্মকর্তা বলেন, নির্দেশনা দিলে ও সদিচ্ছা থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করা সম্ভব।
তবে রাজু বাহিনীর এক শীর্ষস্থানীয় সদস্য এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বন বিভাগের মানুষেরা আমাদের সব ধরনের সহায়তা দেয়। এদের সহায়তা ছাড়া জঙ্গলে থাকা সম্ভব নাকি!’
এই বনদস্যু জানালেন, তাদের টাকায় বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সকল আরাম আয়েশ ও স্বচ্ছলতা চলে। সুন্দরবনে চাকরি করলে বদলির পরও ডাকাতির টাকার ভাগের লোভে তারা আবার বনেই বদলি আসার তদবির করেন।
শুধু বনবিভাগ নয় কোস্টগার্ডের সহায়তার কথাও স্বীকার করেন তিনি। তার ভাষ্য অনুযায়ী কোস্টগার্ড কখন কোথা থেকে বের হয়ে কোথায় যাচ্ছে সে খবর আগেই তাদের কাছে পৌঁছায়।
‘আমরা তাই অযথা তাদের সামনে না পড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাই,’ বলেন এই বনদস্যু।
দস্যুদের এই দাবির সঙ্গে মিল পাওয়া গেল কোস্টগার্ডের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বক্তব্যেও। তবে কোস্টগার্ড ও বনবিভাগ দুষছে একে অপরকে।
তিনি বলেন, বনে দস্যুতা দমনে এই কারণে বন বিভাগের কাছে চারটি ফরেস্ট স্টেশনের জন্য আমরা জমি চেয়েছি। কিন্তু তারা আমাদের জমি দিচ্ছেনা। আবার যেখানে জমি দিয়েছে, সেখানে যাতে কোন স্থাপনা তৈরি করা না যায়, তেমন পরিস্তিতি তৈরি করেছে। এতে বোঝা যায় ফরেষ্টের সাথে ডাকাতদের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে।
মেহেদী মাসুদ বলেন, ডাকাতের বিরুদ্ধে কোস্টগার্ডের অভিযান চালানোর জন্য যে পরিমান সরকারি বরাদ্দ থাকা প্রয়োজন সেই বরাদ্দ ও বাজেটে থাকেনা। আমরা বোট বাড়াচ্ছি। আমেরিকার দেওয়া বোটগুলো হাইস্পিডি কিন্তু আমাদের প্রেক্ষাপটে খুবই ব্যায়বহুল। প্রতিঘন্টায় এই বোটগুলো ২৫ হাজার টাকার ফুয়েল ধ্বংস করে।
তিনি বলেন, মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্কের ব্যাপ্তি উপকারের সাথে ক্ষতিও করেছে। নৌ-পথ হওয়ায় আমরা কখন কোন খাল বা নদী দিয়ে কোন দিকে যাই, তা সোর্সের মাধ্যমে ডাকাতরা জেনে যায়।
কাজী মেহেদী মাসুদ বলেন, ডাকাত দমনে আমরা র্যাবের সাথে অভিযান চালাই। র্যাব ভালো অপারেশন করে। কিন্তু সুন্দরবনে তাদের অভিযান চালানোর অনুমতি নেই। এখানে কাজ করে র্যাব-৮। র্যাবেও খারাপ লোক ঢুকে গেছে। তারা অনেক সময় আমাদের না জানিয়েই অভিযানে নামে। এতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয। র্যাবের অনেক অফিসারই ‘সো মাচ পলিটিক্যাল’। তাদের গোয়েন্দাদের মধ্যেও ঝামেলা আছে। তবে আমাদের গোয়েন্দা শাখা বলতে গেলে কিছুই নেই। পুলিশ ও আমাদের কোন সহায়তা করেনা। ডাকাতের সাথে তাদেরও সম্পর্ক থাকতে পারে।
কোস্টগার্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, আমি মাত্র দুই মাস দায়িত্ব নিয়েছি। এখানে আমাদের লোকদের মধ্যেও কিছু সমস্যা চিহ্নিত করেছি। এইসব সমস্যা ও অভিযোগের কঠোর শাস্তি হবে। এরইমধ্যে কঠোরতা প্রদর্শন শুরু ও হয়েছে।
কোস্টগার্ড কমান্ডার বলেন, ডাকাত দমনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো সিমীতি জলযান ও লোকবল, বাজেট। আমরা সিমীত সুযোগে কাজে লাগিয়েই জলদস্যু ও বনদস্যু দমনে কাজ করছি। সুন্দরবন একটা বিরাট এলাকা। আমরা কাজ করছি। অচিরেই সুফল আসবে।
মাসুদ জানান, বনে কোস্টগার্ডের ৭টি স্টেশন আছে। আরো তিনটির পরিকল্পনা করেছি। পুস্পকাঠি, দেবকি ও কাগা দেবকিতে বন বিভাগ থেকে জমি পেলেই স্টেশন হবে। আসলে এই সামন্য লোকবল ও সম্পদ নিয়ে এতোবড় বিষয় মোকাবেল সম্ভব নয়। আমাদের আরো জনবল ও জলযান দরকার।
তিনি বলেন, আমাদের অনেক ফাঁড়ি বনদস্যুদের কারণে উঠে গেছে। বনের গহীনে কয়েকজন মানুষ কিভাবে চাকরি করছে সে কথা কেউ ভাবেনা। তাই বলে বন বিভাগে যে খারাপ মানুষ নেই তা বলছিনা। ‘শয়তান মানুষ’ সব চায়গাতেই আছে। তবে বিনা চ্যালেঞ্জে যে ডাকাতরা সবকিছু করে যাচ্ছে বিষয়টি তাও নয়।
আমার লোকদের মধ্যেও হতাশা আছে। কিছুদিন আগেও হরিণের মাংসসহ লোক ধরা হলো। পরদিন সকালেই তারা জামিনে বেরিয়ে গেল। এতে বনকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কিভাবে কাজ করবে!
কার্তিক চন্দ্র জানান, বনবিভাগের ঝুঁকিভাতা নেই। রেশন নেই। এই অবস্থায় বনের গহীনে তারা যে ডাকাতের সাথে লড়াই করে মরতে যাবে, তাহলে তাদের পরিবারের দায়িত্ব কে নেবে!
কোস্টগার্ডের অভিযোগ সম্পর্কে তিনি বলেন, অভিযোগ সঠিক নয়। আমাদের কাছে চার একর জমি চাওয়া হয়েছে। আমরা তা দিয়ে দিয়েছি। বরং তারা এর চেয়ে ওই এলাকায় আরো বেশি জমি দখলে নিয়েছে।
রহমান মাসুদ
সুন্দরবন থেকে ফিরে: সুন্দরবনের দস্যুতা চলে প্রশাসনের সহায়তা ও মদদে অভিযোগটা বহু পুরন। তবে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় হীনতা আর এক অপরের প্রতি দোসারপ সে অভিযোগকে আরো জোরাল করে।