দৈবজ্ঞহাটি, মোরেলগঞ্জ থেকে ফিরে: মোট ৮ বোছোরে (বছরে) এরা আমাগো ৬৮ হাজার টাহা (টাকা) দেবে বলে প্রত্যেকের কাছ-তে ৮শ ৫০ করে টাহা নেয়। এখন তারা আমাগো টাহা (টাকা) না দিয়ে নিয়ে পলায়ে (পালিয়ে) যাবার চেষ্টা করছে। আমরা স্যার ৬৮ হাজার চাই না, ৮ শ ৫০ টাহা ফেরত দেন!
বলছিলেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা খালকুলিয়া গ্রামের মোসলেমা খাতুন। ‘শ্যামলী বাংলা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে অর্থ আমানত রাখেছিলেন তিনি।
মঙ্গলবার দুপুরে বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার দৈবজ্ঞহাটি গ্রামে প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টার অভিযোগে ওই প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মকর্তাকে আটকের পর গ্রামের সাধারণ নারীরা এমন অভিযোগ করে।
‘শ্যামলী বাংলা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’ নামে একটি অর্থ লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের তিন কর্মচারিকে প্রায় তিন হাজার ৩১৯ নারীর কাছ থেকে মোট ২৮ লাখ ২১ হাজার টাকা প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাতের অভিযোগ তুলে দুপুরে এলাকাবাসী তিন দিনের মধ্যে ওই টাকা ফেরৎ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসী আটকদের আগামী তিন দিনের জন্য স্থানীয় দৈবজ্ঞহাটি ইউপি চেয়ারম্যান শহিদুল ইসলাম ফকিরের হেফাজতে রাখা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটি দৈবজ্ঞহাটি, বলইবুনিয়াসহ ওই এলাকার কয়েকটি ইউনিয়নে নারী নেত্রী (সদস্য সংগ্রহকারী) তৈরি করে তাদের মাধ্যমে এরাকার নারীদের কাছ থেকে জনপ্রতি সাড়ে ৮শ টাকা এককালীন জমা দিয়ে সদস্যভুক্ত করে। শর্ত অনুযায়ী একজন সদস্যকে পরবর্তী আট বছরের মধ্যে কয়েক দফায় সর্বমোট ৬৮ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
কিন্তু প্রথম দিকে কিছু সদস্য প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা দেওয়া হলেও গত তিন-চার মাস ধরে প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া প্রায় ৬ মাস ধরে সদস্যরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী টাকা পাচ্ছেন না।
আটক ওই তিনজন বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীদের স্বাবলম্বী করার লক্ষ্য নিয়ে ২০০৮ সালে ‘শ্যামলী বাংলা ডেভেলপমেন্ট সোসাইটি’র কার্যক্রম শুরু হয়। তাদের প্রধান কার্যালয় রাজধানীর উত্তরা এলাকায়। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের নাম এনামুল করিম খান। ২০১৩ সালে অক্টোবর থেকে তারা বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার দৈবজ্ঞহাটি ইউনিয়ন ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় কার্যক্রম শুরু করেন। মঙ্গলবার পর্যন্ত তাদের সদস্য সংখ্যা ৩ হাজার ৩১৯ জন।
তারা দাবি করেন, সংগঠনের নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারণে মাঠ পর্যায়ে গ্রাহক সদস্যরা ভুল তথ্য পেয়ে বিভ্রান্ত হয়েছেন। তাদের প্রতিষ্ঠানটি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে মোরেলগঞ্জে কার্যক্রম চালাতে আসেনি।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা ছাড়াও এ জেলার রামপালে তাদের কার্যক্রম রয়েছে। পাশাপাশি বগুড়া এবং গাইবান্ধাও তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চলছে।
বলইবুনিয়া গ্রামের আর এক নারী ফরিদা বেগম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, প্রতি সদস্যকে আট বছরে মোট ৬৮ হাজার টাকা দেওয়ার লোভ দিয়ে তিন হাজার ৩১৯ জন সদস্যের কাছ থেকে প্রায় ২৮ লাখ টাকা আদায় করা হয়েছে। আমি ২৪২ জন সদস্য সংগ্রহ করেছি কিন্তু আমাকে পারিশ্রমিক (জনপ্রতি পঞ্চাশ টাকা) দেওয়া হয়নি। আমরা আমাদের টাকা ফেরৎ চাই।
দৈবজ্ঞাহাটি গ্রামের রঞ্জিদা বেগম বাগেরহাট ইনফো কে বলেন, আমরা আমাদের স্বামীদের না বলে হাঁস-মুরগী, ডিম বিক্রীর টাকা থেকে শ্যামলী বাংলাকে টাকা দিয়েছি। আমাদের হাজার হাজার টাকার লোভ দেখানো হয়েছে। আমরা আমাদের টাকা ফেরৎ চাই।
তবে এলাকাবাসীর হাতে আটক সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম সরকার মঙ্গলবার বিকেলে বাংলানিউজকে বলেন, নির্বাহী পরিচালক আল মাহফুজ সিদ্দিকী স্থানীয়। তার বাড়ি মোরেলগঞ্জে। সদস্যদের টাকা আদায় করে সব টাকা তিনি যথাযথভাবে জমা করেননি। এ কারণে তাকে দায়িত্ব থেকে অপসারণ করা হয়েছে। আমি এবং আব্দুর রহিম ঘটনাটি তদন্ত করতে এসেছিলাম। মাহফুজ নিজের দোষ ঢাকতে বিভিন্নভাবে এলাকার মানুষকে প্ররোচিত করে এই অসন্তোষ সৃষ্টি করেছেন।
এব্যাপারে দৈবজ্ঞহাটি ইউপি চেয়ারম্যান শহীদুল ইসলাম ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে সংগঠনটির কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ায় লগ্নিকারী নারী সদস্যরা উদ্বিগ্ন ছিলেন। সোমবার গভীর রাতে এই ৩ জন নিজেদের কার্যালয়ে বসে নিজেদের মধ্যে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন।
বিষয়টি জানাজানি হলে সকালে সদস্যরা ওই প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে জড়ো হতে থাকেন এবং তিন জনকে টাকা ফেরৎ দেওয়ার দাবিতে ঘেরাও করে রাখেন। দুপুরে খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেন।
এলাকাবাসী তিন দিনের মধ্যে টাকা ফেরৎ পাবার দাবি জানিয়েছে।
সমস্যা সমাধানে তিনি ওই ৩ জনের কাছ থেকে পাওয়া মুঠোফোনের সূত্র ধরে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান এনামুল করিম খানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। বর্তমানে ওই ৩ জন তার (চেয়ারম্যানের) জিম্মায় রয়েছেন।