রাজু মল্লিক, কাগজে কলমে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র। তবে বাস্তবতা হল এখন আর স্কুলে যায় না সে।
সুন্দবরন সংলগ্ন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার ঘুলিশা খালি গ্রামের বাসিন্দা রাজু। তার কাছে বিদ্যালয় থেকে অনেক বেশি প্রিয় সুন্দরবন।
কারন এ বন তাকে এবং তার পরিবারকে প্রতিদিন দিচ্ছে অর্থের যোগান। আর তার মতন তার পরিবারেরও ভাবনা বনে গিয়ে পরিবারে উপার্জনে সাহায্য করুক রাজু। তাই তো স্কুল চলাকালীন সময়ে সুন্দরবনে খালে রেনু (চিংড়ি পোনা) আহরনে ব্যস্ত সে।
সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের লোকালয় সংলগ্ন ঘুলিশা খালি খালে রাজু মল্লিকসহ ক’য়েক শিশুর সাথে দেখা হয় আমাদের। যাদের সবার বয়স ১৩ বছরের নিচে হবে। ঘড়ির কাটায় তখন আনুমানিক বেলা সাড়ে ১২টা।
জলে কুমির আর ডাঙ্গায় বাঘ- এটি যেন তাদের কাছে কেবলই প্রবাদ বাক্য ছাড়া আর কিছুই না! নেই তাদের বাঘের ভয়, নেই কুমিরের! তাই তো একটু কৌতুহল নিয়ে জানতে চাইলাম- কি করছ এখানে? রাজু জানায়, “তারা রেনু ধরছে। নেট জাল দিয়ে এখান থেকে রেনু (চিংড়ি পোনা) ধরে বিক্রি করি”। রেনু বিক্রি করে প্রতিদিন কেমন টাকা পাওয়া যায় জানতে চাইলে তরিকুল ইসলাম (১০) নামে আর এক শিশু জানায়, প্রতিদিন ৭০-৮০ কখনও ১০০টা পায় তারা।
কেবল রেনু সংগ্রহ নয় এই শিশুদের কেউ আবর এসেছে পরিবারের খাবারের জন্য মাছ ধরতে। মেহেদি হাসান (১৩) তার ছোট ভাইকে নিয়ে বাড়ির পাশের এ খালে তখন মাছ ধরছিল পরিবারের দু’বেলা খাবারের মাছ সংগ্রহের জন্য। এই খালের আশপাশে ছিলেন স্থানীয় প্রবীণ কয়েক জনও। শিশুদের এমন সুন্দরবন নির্ভরতা নিয়ে কথা হয় তাদের কয়েক জনার সাথেও।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে বেশ গভীর ভাবেই নিজের ভাবনার কথা গুলো জানালেন সুন্দরবনে আমাদের সফর সঙ্গী সুন্দরবন পূর্ব বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) আমীর হোসাইন চৌধুরী। বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, ‘সুন্দরবন সংলগ্ন ১৭ উপজেলার প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ভাবে নির্ভরশীল সুন্দরবনের উপর। যাদের বেশির ভাগের মূল পেশা মাছ ধরা।’
পরিবেশ সর্বদা মানুষের উপর প্রভাব ফেলে। পিতা-মাতার হাত ধরে এখান কার শিশুরাও আস্ত আস্তে হয়ে ওঠে সুন্দরবন নির্ভর। এভাবেই এসব শিশুদের বেড়ে ওঠা। তবে এভাবে চললে সুন্দবরব যে তার সৌন্দর্য্য হারাবে, জীববৈচিত্র ধ্বংস হবে তা মেনে নিয়েই আমাদের সফর সঙ্গি আমীর হোসাইন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবন সংরক্ষনে সল্প মেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি একটি নিদৃষ্ট প্রজন্মকে টার্গেট করে দির্ঘ্য মেয়াদে কাজ করা দরকার।
তবে তার মতে এসবের পাশাপাশি এখনই একটি প্রজন্মকে টার্গেট করে কাজ শুরু করা দরকার। যেখানে বন সংলগ্ন এসব শিশুদের বিদ্যালয় গমন নিশ্চিতের পাশাপাশি ঝরে পড়া ঠেকাতে হবে। আর এভাবে এসএসসি, এইচএসসি পস করে গেলে তখন তারা আগ্রহী হবে উচ্চ শিক্ষায়। চেষ্টা করবে শহর, বন্দরগামী হতে। চাকরি বা অন্য পেশায় গিয়ে জীবন মান পাল্টাতে।
আর এই পর্যায়ে এসে জীবিকার জন্য আবারও তাদের কেউ সুন্দরনব আসলেও তখন আর তারা প্রকৃতির ক্ষতি করবে না। তারা জেলে, মৌয়াল বা কাঠ সংগ্রহের জীবন বেছে নিবে না। তখন তারা টুরিস্ট গাইড বা ইকো টুরিজমে নিজেদের সম্পৃক্ত করবে।
আর তা সম্ভব হলে বনের উপর বোঝা সৃষ্টিকারী সুন্দরবন সংলগ্ন জনগোষ্ঠিরাই (পরবর্তি প্রজন্ম) বন সংরক্ষন ও জীববৈচিত্র রক্ষায় এগিয়ে আসবে বলে মনে করেন এই বন কর্মকর্তা।