বসতি নির্মানের নামে ধ্বংস করা হচ্ছে সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যভুক্ত বাগেরহাটের ‘৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট বড় আজিনা মসজিদ’ এর নিদর্শন বা ‘বড় আজিনা প্রত্নতাত্ত্বিক ঢিবি’টি।
ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদসহ তৎকালীন খলিফাতাবাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা হযরত খানজাহান (রহঃ) এর সময়কালের দ্বিতীয় বৃহৎ এ স্থাপনাটির মাটি খুঁড়ে তুলে ফেলা হচ্ছে ইট ও পাথরের ভিত্তি।
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে প্রত্নতাত্বিক এই নিদর্শন ধ্বংসের প্রক্রিয়া চললেও তা প্রতিহত করাতে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি সংশ্লিষ্ট মহল।
২০১১ সাল থেকে সাংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সংরক্ষিত প্রত্নতত্ত্ব হিসেবে গেজেটভুক্ত হলেও তৎকালীন খলিফাতাবাদ নগরীর প্রতিষ্ঠাতা ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ সমসাময়িক এই ‘বড় আজিনা’ ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষনে আজও কোন উদ্যোগ নেয় নি সরকার।
তবে ‘বড় আজিনা’ নিয়ে তেমন কোন প্রত্নতাত্ত্বিক কাজ না হওয়ায় ধ্বংসপ্রাপ্ত এই স্থাপনাটি সম্পর্কে তথ্যের অভাব রয়েছে।
বইতে উল্লেখ আছে, এখানে ৩৭ মিটার দৈর্ঘ্য ও ২৯ মিটার প্রস্থের ১৮টি স্তম্ভ বিশিষ্ট একটি স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত পাঁচটি স্তম্ভের উলম্ব প্রস্তর সারির প্রথম অংশটি এখনও মাটির উপরে দন্ডায়মান।
তবে বাগেরহাট ষাটগম্বুজ যাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো: গোলাম ফেরদৌস ওই বইয়ে উল্লেখিত এ স্থাপনার বিষয়ে কিছুটা ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘বড় আজিনা’ সম্ভবত ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট একটি একটি মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। যশোরের বারোবাজারের খানজাহানের সময়কালের ৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট সাতগাছিয়া মসজিদের ধ্বংসাবশেষের সাথে এর প্রচুর সাদৃশ্য রয়েছে।
তার মতে, ষাটগম্বুজ মসজিদের পর বাগেরহাটে এটিই সম্ভবত হযরত খান জাহান (র:) এর সময়কালের দ্বিতীয় বৃহৎ মসজিদ বা স্থাপত্ত।
অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে ঐ স্থাপনার প্রচুর পরিমাণ প্রাচীণ ইট। কেটে নেয়া মাটি দিয়ে পাশের কিছু নীচু এলাকা ভরাট করা হচ্ছে।
ঐ স্থানটির সামান্য উত্তর দিকে ঢিবির মধ্যভাগে রয়েছে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি সতর্কীকরণ নোটিশবোর্ড। সেখানে ১৯৬৮ সালের পূরাকীর্তি আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারার কথা উল্লেখ করে এই স্থাপনা ধ্বংস, অনিষ্টসাধন, বিকৃতি বা অঙ্গচ্ছেদ না করতে বাংলা ও ইংরেজিতে জনসাধারণকে সতর্ক করা হয়েছে।
এই প্রতিবেদক সেখানে থাকা অবস্থায় শ্রমিকরা স্থাপনার ভগ্নাবশেষের পূর্ব দিকের একটি থাম এর (পিলার) নীচের দিকের দুটি চৌকোনা পাথর তুলে ফেলেন। প্রায় দুই ফুট দৈর্ঘের বর্গাকৃতি এই বেলে পাথর দুটির উচ্চতা প্রায় ছয় ইঞ্চি। পাথর দুটি চুন-শুরকির আস্তর ও লোহার খিলান দ্বারা একটির উপর আরেকটি সংযুক্ত ছিলো।
অনুসন্ধানে জান গেছে, ২০১০ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের সাংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বড় আজিনা প্রত্নতাত্বিক ঢিবি’র অবস্থানটি ১৯৬৮ সালের প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষন আইন অনুযাই পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষনা করে। এর পর ২০১১ সালের ৩১ মার্চ মন্ত্রণালয়ের গেজেট ভুক্ত করে প্রজ্ঞাপন জরি করে।
এর মাধ্যমে খানজাহানের বসতভিটা থেকে প্রায় সাড়ে চার কি:মি: দক্ষিণ-পূর্ব দিকে বর্তমান বাগেরহাট শহরের সোনাতলা মৌজায় (জমির খতিয়ান নং ৬২, দাগ নং ৬৮৩) দুই দশমিক ৯০ একর জমি সংরক্ষিত হিসাবে ঘোষনা করা হয়।
গেজেট অনুযাই ওই জমির মালিকানা রয়েছে জনৈক দ্বীন মোহম্মদ মোল্লা, আব্দুল জব্বার পাইক, আব্দুল মজিদ পাইক এবং এনায়েত মোল্লার নামে। বর্তমানে এই ঢিবি ধ্বংস করে ঘর বানানোর কাজটি করছেন স্থানীয় মনিরুজ্জামান মোল্লার ছেলে বুলবুল মোল্লা (৩৪)। দ্বীন মোহম্মদ মোল্লা এই বুলবুল মোল্লার পিতামহ।
এটি যে রাষ্ট্র কর্তৃক সংরক্ষিত এলাকা তা জানেন কি না জানতে চাইলে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, ‘ছোটবেলা থেকে তা শুনেছি। কিন্তু এটাতো একটা ধ্বংসস্তুপ। এটা দিয়ে কি হবে!’
বৃটিশ আর পাকিস্তান আমলে বাড়ি-ঘর, শহরের রাস্তা করতে লোকজন এখানকার ইট নিয়ে গেছে বলে শুনেছি। পাথরগুলো পড়ে আছে, আমরাই পাহারা দেই। এতদিন জমি কাজে লাগেনি, এখন দরকার। তাই ঘর বানাচ্ছি।
কেউ তাকে এই কাছে বাধা দিয়েছেন কিনা বা নিষেধ করেছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন আগে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের দু’জন লোক এসেছিলেন। তারা কাজ দেখে প্রশংসা করে বলেছেন যে, মাটি কেটে খানা খন্দর বন্ধ করে আমি ভালো কাজ করছি।’
বৃহস্পতিবার জিডি হয় নি জানিয়ে বাগেরাহট মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী আযম খান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে শুক্রবার বিকালে বলেন, প্রত্তনত্ত্ব অধিদফতরের অভিযোগটি আজ (শুক্রবার) জিডি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
তবে বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ.এফ.এম. এহতেশামুল হক মুঠোফোনে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এ ধরণের কোন অভিযোগ প্রসঙ্গে আমাকে কেউ এখনও অবহিত করেনি।’