সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে ‘বাঘে’র সংখ্যা জানতে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ পদ্ধতিতে চলা গণনার ফলাফল ঘোষণা করা হবে চলতি বছরের জুন মাসে।
ধারণা করা হচ্ছে আগামী জুন মাস নাগাদ সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে কত বাঘ (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) আছে তার চূড়ান্ত ও যথাযথ সংখ্যা পাওয়া যাবে।
এর আগে সর্বশেষ ২০০৪-০৫ পাগ-মার্ক বা পায়ের ছাপ পদ্ধতিতে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরননে বাঘ শুমারি করা হয়েছিল।
ওই পদ্ধতিতে বাংলাদেশ অংশে ৪৩০টি এবং ভারতীয় অংশে ২৭০টি বাঘ রয়েছে বলে জানা গিয়েছিল।
কিন্তু কর্মকর্তারা এখন বলছেন, সুন্দরবনের জন্য পাগ-মার্ক পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। ফলে, বাঘের সংখ্যা বেশি উপস্থাপিত হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে বাঘের সংখ্যা আরো কম।
বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. জাহিদুল কবির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, প্রথম ধাপে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব ব্লকে ৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ‘ক্যামেরা ট্র্যাপে’র মাধ্যমে গণনা করা হয়।
‘দুই ধাপে পাওয়া তথ্য উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে জুন মাসে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হবে’ বলে, জানান তিনি।
এর আগে গত বছরের এপ্রিলে গণনার প্রথম ধাপ শেষ হয়। তবে তখন সে গণনার ফলাফল ঘোষণা করেনি সংশ্লিষ্টরা।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্প বিষয়ক আঞ্চলিক সহযোগিতায় ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৩ সালে সুন্দরবনে বাঘ গণনা শুরু হয়।
চলতি বছরের (২০১৫ সালের) জুনে যা শেষ হবার কথা রয়েছে। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা।
বাঘ গণনার প্রথম ধাপ শেষ হয় ২০১৪ সালের এপ্রিলে। সে সময় বাঘের ছবি ধারণের জন্য সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে ৮৯টি স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা বসানো হয়েছিল।
ডিএফও মো. জাহিদুল কবির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে সোয়া ৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৩ শ ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নমুনা অংশ ধরে তিনটি ব্লকে ভাগ করে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপিং’ পদ্ধতিতে বাঘের ছবি সংগ্রহ করা হচ্ছে।
প্রথম ধাপে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব ব্লকে ৭০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ‘ক্যামেরা ট্র্যাপে’র মাধ্যমে গণনা করা হয়। একই পদ্ধতিতে ২য় ধাপে দক্ষিণ ব্লকে ৬৪০ বর্গকিলোমিটারে ছবি তোলা চলছে। মার্চের শেষে বন থেকে ক্যামেরা তুলে আনা হবে। জুন মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে জানানো হবে বাঘ গণনার ফলাফল।
ক্যামেরা ট্র্যাপিং:
বাঘ শুমারী বাস্তবায়নের অন্যতম কুশীলব জাহিদুল কবির আরো জানান, গণনায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা। যা বাঘের চলাচলে এলাকা সনাক্ত করে গোপনে গাছে লাগিয়ে রাখা হয়। ক্যামেরার সামনে যা কিছুই নড়াচড়া করবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারই ছবি ধারণ করবে।
এই ক্যামেরাগুলো সারাক্ষণই চালু থাকে এবং লেন্সের সামনে কোনও নড়াচড়া ধরা পড়লেই স্বংয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলে।
এর আগে সুন্দরবনের ভারত অংশেও এই ক্যামেরা ট্র্যাপ পদ্ধতি ব্যবহার করে বাঘ গণনা করা হয়েছে। ভারতে যে বিশেষজ্ঞরা গণনা করেছেন, বাংলাদেশেও গণনায় তাঁরা সহযোগিতা করছেন বলে জানান জহিদুল কবির।
প্রকল্পের কর্মীরা প্রতি ৫দিন পর এসে ক্যামেরাগুলোর ব্যাটারি বদলে দেন এবং মেমোরি কার্ড খুলে ক্যামেরায় নতুন মেমোরি কার্ড লাগিয়ে দেন।
পরে প্রাপ্ত তথ্য ও নমুনাকে সফটওয়্যারের মাধ্যমে বিশ্লেষণ করে একটি চূড়ান্ত সংখ্যা নির্ণয় করা হবে।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) ২০১০ সালে রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিপণ্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করেন।
একাধিক সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বন বিভাগের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ১৯৮২ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে ৪৫৩টি বাঘ ছিল। ২০০৪ সালে এ সংখ্যা ৪৪০ টি। তবে খাদ্য ও কৃষি সংস্থা পরিচালিত এক জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বাঘের সংখ্যা ৩৬৯টি।
সুন্দরবনে বাঘের জীবনচক্র:
বাঘ (বেঙ্গল টাইগার বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার) বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী। (Panthera tigris) বিশাল বিড়াল পরিবারের শ্রেণী র্ভূক্ত প্যানথেরা গোত্রের অন্তর্ভূক্ত স্তন্যপায়ী প্রানী বাঘ।
“অ্যানিম্যাল প্লানেট” চ্যানেলের এক সমীক্ষা অনুযায়ী বিশ্বের সচচেয়ে জনপ্রিয় প্রাণী হচ্ছে বাঘ।
বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোঃ জাহিদুল কবির জানান, চার বছর বয়স থেকে বাচ্চা দেয়া শুরু করে বাঘিনী। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বছর বছর বাচ্চা দেয় না। দুই থেকে তিন বছরে একবার বাচ্চা দেয়।
সাধারনত এক বছর পর্যন্ত মায়ের সাথে বেশি দূরে বা শিকারে যায় না। এক বছরের পর মায়ের সাথে শিকারে যেতে শুরু করে এবং বিভিন্ন কলা কৌশল শেখে। দুই থেকে আড়াই বছরে মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। নিজরে টেরিটোরি প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে।
টেরিটোরি প্রতিষ্ঠা করে জুটি খুজতে শুরু করে। সাড়ে তিন বছর বয়সের মধ্যে জুটি খুজে নেয়।
সুন্দরবনে বাঘের গড় আয়ু ১৫ থেকে ১৮ বছর। তবে চিড়িয়াখানায় বাঘ আরো বেশি দিন বাঁচতে পারে। ১২ বছর বয়স হলে সেই বাঘকে বৃদ্ধ বলে ধরা হয়।
এরপর আস্তে আস্তে তার ক্ষমতা কমতে থাকে। তবে সাধারণত ১০ বছর বয়সের পর বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা থাকে না।
এক গবেষণায় দেয়া গেছে, বাঘের প্রিয় খাবার হরিণ। যেখানে পর্যাপ্ত খাবার আছে। যেখানে কেউ তাকে বিরক্ত করবে না অর্থাৎ নিরাপদ এলাকা বাঘ বসবাসের জন্য বেছে নেয়।
সুন্দরবনে সব এলাকায় বাঘের চলাচল দেখা যায়। তবে সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় বাঘের সংখ্যা বেশি বলে ধারণা করা হয়। সাতক্ষীরা ছাড়াও চাঁদপাই রেঞ্জ, শরণখোলা, কটকা ও কচিখালি এলাকায় বাঘ বেশি রয়েছে।