প্রচ্ছদ / লেখালেখি / অণুকথা / অপরিণামদর্শিতা থেকে মুক্তি পাক ২৯৩ নদী-খাল

অপরিণামদর্শিতা থেকে মুক্তি পাক ২৯৩ নদী-খাল

সারাবিশ্বেই পরিবেশ বিপর্যয় এক বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগেরই জন্য দায়ী মানুষের সীমাহীন লোভ ও অপরিণামদর্শিতা।

নদীমাতৃক বাংলাদেশের প্রকৃতি-পরিবেশ মূলত নদী-খাল-বিল-হাওর ইত্যাদির মতো প্রাকৃতিক জলাশয়নির্ভর। কিন্তু গত ক’দশকে দেশের অসংখ্য নদী-শাখানদী ও খাল তাদের স্বাভাবিক নাব্যতা হারিয়েছে; বিশেষ করে খালগুলির অবস্থা সবচেয়ে করুণ।

এদের বেশিরভাগই দখল হয়ে গেছে; ভরাট হতে হতে কোনো কোনোটির মরণদশা ঘনিয়ে এসেছে। প্রভাবশালীদের নানামুখি দৌরাত্ম্যসহ নানাবিধ মানবসৃষ্ট কারণে এহেন অবস্থা। কিন্তু সবচে করুণ অবস্থা দেশের দক্ষিণাঞ্চলের চিংড়িপ্রধান এলাকার নদী-খালগুলোর। সেখানকার মূল সমস্যা লবণাক্ততা ও জলাবদ্ধতা। আর এর জন্য দায়ী চিংড়িঘের মালিকদের দৌরাত্ম্য ও নানাবিধ অবৈধপন্থা।

পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত তিন যুগ ধরে প্রভাবশালী ও অতিলোভী চিংড়ি চাষীরা কৃষিজমিতে লবণপানি আটকে রেখে চিংড়ি চাষ চালিয়ে যাওয়ায় বাগেরহাটের মংলা ও রামপাল উপজেলায় একটি বা দুটি নয়, ২৯৩টি ছোট-বড় নদী ও খাল নাব্যতা হারিয়েছে।

এসবের মধ্যে দেশের একমাত্র আন্তর্জাতিক নৌপথ বলে পরিচিত মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলও রয়েছে।  জোয়ার-ভাটায় নদীর পানি শাখা খালসহ দুই পাশের প্লাবন ভ‚মিতে ওঠা-নামা করতে না পারায় পলি জমে নদী ও প্রধান খালগুলো ভরাট হয়ে গেছে। মাটি ও পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণের কারণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে কৃষি ও সবুজ বেষ্টনী। পানি চলাচলের প্রাকৃতিক পথ বন্ধ করে দেয়ায় সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। দেখা দিয়েছে পরিবেশ বিপর্যয়।

চিংড়ি চাষের নামে বছরের পর বছর ধরে লবণ পানি আটকে রাখায় জমির উর্বরা শক্তি নষ্ট হতে হতে এখন সেগুলো শস্য চাষের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। এখনই যত্রতত্র চিংড়ি চাষ নিয়ন্ত্রণ ও নদী-খালের অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে প্লাবন ভ‚মি তৈরি করা না গেলে নিকট ভবিষ্যতে এই এলাকা মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

এই আশঙ্কাকে এখনই আমলে না নিলে ওই অঞ্চলটি আর মানুষের বসবাসের উপযোগী থাকবে না। থাকবে না কোনো রকমের কৃষিকাজের উপযোগী। নৌপথ আর থাকবে না নৌ-চলাচলের উপযোগী। এটা শুধু বাগেরহাট নয়, গোটা দেশের সামগ্রিক জৈবপরিবেশ ও জলবায়ুর ওপর এর চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

চিংড়ি চাষ দেশের অর্থনীতিতে বড় অবদান রাখছে সন্দেহ নেই। দেশের প্রধান এক রপ্তানি পণ্য এই চিংড়ি। কিন্তু চিংড়ি চাষের নামে দেশের জৈব পরিবেশ, মাটি পানি নষ্ট করে, অন্যসব ফসল চাষের সকল পথ বন্ধ করে, জমির উর্বরতা চিরতরে নষ্ট করার যৌক্তিকতা কোথায়? লাখো দরিদ্র মানুষকে জমিহারা করে, অবৈধ ও অন্যায় পন্থায় চিংড়ি চাষ কোনোমতেই কাম্য নয়।

বলা বাহুল্য, দক্ষিণাঞ্চলে বিশেষ করে বাগেরহাটে চিংড়ি চাষ হচ্ছে অবৈধ পন্থায়। সেখানে দীর্ঘদিন ধরে চিংড়ি চাষ করার নামে অসংখ্য খাল ও জলাভূমি দখল করা হয়েছে। খালগুলোতে অন্যায়ভাবে বাঁধ দিয়ে জোয়ারভাঁটা আটকে দেয়া হয়েছে। ‘প্রবহমান খালকে বদ্ধ জলাভূমি দেখিয়ে ইজারা নিয়ে’ চিংড়ি চাষ করে চলেছে প্রভাবশালী চক্র।

আজ রামপালের জৈব ও প্রাকৃতিক পরিবেশ ভয়াবহ অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে পানযোগ্য সুপেয় পানি বলতে কিছু আর নেই। জমির উর্বরতাও নেই। অথচ এই এলাকাটি নিকট অতীতেও ছিল সজলা সুফলা

‘গোলা ভরা ধান, পুকুরে বড় বড় মাছ ছিল, শাকসবজি, নারকেল, সুপারি ছিল প্রচুর’। রামপালকে এক সময় বলা হতো ‘ধানের দেশ’। অবৈধ পন্থায় চিংড়ি চাষ আজ সেই শস্যশ্যামল ধান্যসমৃদ্ধ এলাকাটিকে লবণদুষ্ট নিষ্ফলা ভূমিতে পরিণত করে ফেলেছে। লাখো নিরূপায় চাষী ও দরিদ্র মানুষকে ঘেরমালিকরা ছলে-বলে-কৌশলে বাধ্য করেছে তাদের জমি বিক্রি করে দিতে। খাদ্য ও পানীয়জলের অভাবে, লবণদুষ্ট জমিতে কৃষিকাজ করতে না পেরে অনেকে ভিটেমাটি ছেড়ে জীবিকার সন্ধানে এলাকা ছেড়েছে।

আর খাল-নদীগুলো নাব্যতা হারিয়ে এমন অবস্থায় পৌছেছে যে নৌচলাচল ব্যাহত হচ্ছে। ভবিষ্যতে সমস্যাটা আরো প্রকট রূপ নিতে পারে। তাই এ মুহূর্তে সবার আগে দরকার বাগেরহাটের চিংড়িপ্রধান এলাকার খাল-নদীগুলোকে প্রভাবশালী চিংড়িঘের মালিকদের নানাবিধ অপকর্ম থেকে রেহাই দেওয়ার ব্যবস্থা করা। খাল-নদীগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য নিতে হবে সমন্বিত ব্যবস্থা।

মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলসহ প্রধান প্রধান নদী ও খালগুলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক প্রবাহ ঠিক রাখার একটা উপায় হচ্ছে এসবের দুই পাশে প্লাবন ভূমি গড়ে তোলা। আর এজন্য বড় প্রতিবন্ধক অবৈধ চিংড়িঘের। এগুলোকে প্রবাহ পথ থেকে সরাতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন পলি জমে সংকুচিত হয়ে পড়া খাল নদীতে নিয়মিত হারে ড্রেজিংয়ের ব্যবস্থা করা।আশার কথা,  আটক রাখা এসব নদী-খালের বাঁধ অপসারণ ও পুনঃখননের কাজ শুরু হয়েছে সম্প্রতি।

এই কাজ যেন মাঝপথে কারো অঙ্গুলি নির্দেশে থমকে না যায়। আমরা আশাবাদী হতে চাই। নদী ও প্রাকৃতিক প্রবাহগুলোকে দেখতে চাই তাদের স্বাভাবিক রূপে। কেননা নদীমাতৃক বাংলাদেশে খালা-নদী ও প্রাকৃতিক জলাশয় আমাদের ‘লাইফ লাইন’।

… … ….
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
এস/আইএইচ/এনআরএ/বিআই

About ইনফো ডেস্ক

পূর্বের বাগেরহাটে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ কর্মশালা
পরের গায়ের জোরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মান করছে সরকার