প্রচ্ছদ / খবর / হতে পারে ‘মিনি সুন্দরবন’

হতে পারে ‘মিনি সুন্দরবন’

শান্ত নদী চিত্রা। দুই পাড় জুড়ে কেওড়া, গোলপাতা, ওড়াসহ বিভিন্ন গাছগাছালির সমাহার। তীরের নরম মাটি ফুঁড়ে জেগে উঠেছে শ্বাসমূল। গোলপাতা গাছের কাঁদিতে গোল ফল কিম্বা কেওড়া গাছে সদ্য ফোঁটা ফুল দৃষ্টি কাঁড়বে যে কারোরই।

বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় বয়ে যাওয়া চিত্রা নদীর দুই পাড়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ কিলোমিটার জুড়ে দেখে মিলবে এমন দৃশ্যের। প্রাকৃতিকভাবে গড়ে ওঠা নয়নাভিরাম এ দৃশ্য দেখে মনে হতে পারে এটাই সুন্দরবন।

চিত্রা চরের এ বনে বাঘ, হরিণ না থাকলেও স্থানীয়দের কাছে এর পরিচিতি এখন ‘মিনি সুন্দরবন’ নামে। এই ‘মিনি সুন্দরবন’ নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই তাদের।

সরেজমিনে দেখা যায়, এক সময়ের খরস্রোতা চিত্রা নদীর চরজুড়ে এখন সবুজের সমারোহ। দুই পাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। নদী সংলগ্ন গ্রামগুলোর অনাবাদি জমি এবং বসত বাড়ির আশপাশেও জন্ম নিয়েছে গোলপাতা, কেওড়াসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছপালা ও লতাগুল্ম।

জোয়ারের সময় নদী তীরের গাছগুলোর কিছু অংশ পানিতে ডুবলেও ভাটার সময় আবার তা জেগে ওঠে। চিত্রা সংলগ্ন ছোট ছোট খাল গুলোতেও দেখা মিলে এ দৃশ্য।

বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের মূল ভূখণ্ড থেকে প্রায় ৭০ কিলোমিটার উত্তরে চিতলমারী উপজেলার চিত্রা পাড়ে দিন দিন বাড়ছে গাছের সংখ্যা। জোয়ার-ভাটার নদী হলেও শীত মৌসুমে পানির চাপ থাকে কম। আসে বিভিন্ন প্রজাতির অতিথি পাখি।

চিতলমারী উপজেলার রায়গ্রাম, শুরিগাতী, খিলিগাতী, করাতদিয়া, ডুমুরিয়া, আড়ুলিয়া, খাড়িয়াসহ নদীতীরের অধিকাংশ গ্রামই এখন মিনি সুন্দরবনের অংশ।

স্থানীয়রা জানায়, দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে চিত্রা নদীর চরে বেলে-দোঁআশ মাটিতে গোলপাতা, কেওড়াসহ সুন্দরবনের গাছপালা জন্মাতে শুরু করে। গত কয়েক বছরে এখানে গাছের ঘনত্ব বেড়েছে। বর্তমানে এখান থেকে গোলপাতা বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন তারা। তবে অবাধে গাছপালা কেটে নিলেও উদ্যোগ নেই রক্ষণাবেক্ষণের।

স্থানীয় মাঝি আবুল কাসেম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, চিতলমারীর ঐতিহ্যবাহী চিত্রা নদী এখন প্রায় মরে গেছে। এক সময় নদীর অংশ চরের জমিতে আপনা-আপনিই বিভিন্ন গাছ জন্ম নিয়েছে। প্রয়োজনে স্থানীয়রা ‘চিত্রা সুন্দরী’ বন থেকে গাছ কাটে, আবারও এখানে গাছ জন্ম নেয়।

মূলত জোয়ারের পানির সঙ্গে সুন্দরবন থেকে ভেসে আসা বিভিন্ন গাছের বীজ (ফল) থেকেই চরে এ বনের সৃষ্টি হচ্ছে বলে জানান উপজেলার ডুমুরিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হরেন্দ্রনাথ রানা।

তিনি বলেন, সুন্দরবনের বিভিন্ন নদ-নদীর সঙ্গে যোগ আছে চিত্রা নদীর। জোয়ারের সময় এসব নদী দিয়ে সরাসরি ভেসে আসে বিভিন্ন প্রজাতির গাছের বীজ। এসব বীজ থেকে জন্ম নেওয়া গাছে নদী তীরের গ্রামগুলো দিনে দিনে আচ্ছাদিত হচ্ছে ঘন বনে।

প্রথম দিকে এখানে কেবল গোলপাতা গাছ দেখা যেত। বর্তমানে এখানে কেওড়া, ওড়াসহ সুন্দরবনের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ রয়েছে। দেখতে সুন্দরবনের মতোই। এখানকার গাছপালা সঠিক ভাবে বাড়তে দিলে মনোরম এই পরিবেশ ‘মিনি সুন্দরবন’ হিসেবে দর্শনার্থীদের কাজে জনপ্রিয় করে তোলা সম্ভব বলে মনে করেন ওই শিক্ষক।

বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহ আলম ফরাজী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, মূলত চিত্রা চরের মাটি এবং এখানকার পরিবেশ সুন্দরবনের গাছাগাছালি জন্মানোর জন্য বেশ উপযোগী। জোয়ার-ভাটা, নোনা পানি এবং উপযুক্ত পরিবেশ পাওয়ায় চরের ম্যানগ্রোভ বন দ্রুত বাড়ছে।

স্থানীয় ডুমুরিয়া, আড়ুলিয়া, করাতদিয়াসহ নদী তীরের গ্রামবাসীরা জানায়, কেবল মনোরম দৃশ্য আর প্রাকৃতিক পরিবেশই নয় বেশ কয়েক ধরনের বন্যপ্রাণির বসবাস এখানে। মেছো বাঘ, বাঘডাসা, খাটাশ, বনবিড়াল, সারেল, বিষধর সাপ, তক্ষক, কচ্ছপ, গুঁইসাপসহ বিভিন্ন প্রজাতির উভচর ও সরিসৃপ প্রাণির অবাধ বিচরণভূমি এ বন। মাছরাঙা, ঘুঘু, শালিক, দোয়েল, টুনটুনি, লেউ লেউ, বকসহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখির আবাসস্থলও এখানকার গাছপালা।

চিতলমারী চিতলমারী সদর ইউপি চেয়ারম্যান শেখ নিজাম উদ্দিন বলেন, চিতলমারী সদর ইউনিয়নের সীমান্ত ঘেঁষা চিত্রা নদীর চরে ২০/২২ বছর ধরে প্রাকৃতিকভাবে এ গাছপালা জন্মেছে। এটা এই অঞ্চলের মানুষের জন্য প্রকৃতির আশীর্বাদ। সুন্দরবনের গাছপালার সমাহার থাকায় স্থানীয়রা এর নাম দিয়েছে মিনি সুন্দরবন।

সরকারি পিসি কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞানের প্রফেসর বুলবুল কবির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে সুন্দরবনের আয়তন বর্তমানের প্রায় দ্বিগুণ ছিল। সে সময় পদ্মার এপার মাদারীপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল সুন্দরবন। সময়ের পরিক্রমায় বনে মানুষের চাপ বাড়ায় ক্রমে ছোট হয়ে এসেছে বন। চিত্রা চরে ম্যানগ্রোভ জন্মানোর উপকূলীয় পরিবেশ থাকায় এখানে সুন্দরবনের গাছপালা বেড়ে ওঠাই স্বাভাবিক।

সম্প্রতি চিত্রা চরের ওই এলাকা ঘুরে এসেছেন বাগেরহাটে সামাজিক বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা হারুন আর রশিদ মজুমদার। তিনি বলেন, গোলপাতা, কেওড়া, ওড়াসহ বিভিন্ন গাছপালা ও লতাগুল্মে ঘেরা চিত্রা নদীর দুই কূলের পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। এখানকার গাছপালা প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখছে। তাই যথাযথভাবে সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেবেন তারা।

তবে, অবস্থানগত কারণে এখনই ওই এলাকায় বন বিভাগের অফিস স্থাপন করা সম্ভব না জানিয়ে তিনি বলেন, দর্শনার্থীদের কাছে মনোরম এই স্থানটি তুলে ধরতে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি ও অনান্য সুবিধা বৃদ্ধির জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে।

১৫ নভেম্বর :: সরদার ইনজামামুল হক,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
এস/আইএইচ/এনআরএ/বিআই

About Inzamamul Haque

পূর্বের বাগেরহাটের শরণখোলায় সিডর দিবস পালিত
পরের সরকারি কাজে বাধা: রামপালে আ.লীগ নেতা আটক