বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনে জলভাগের ‘প্রহরী’ খ্যাত সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী কুমিরের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে এসেছে। সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বর্তমানে মাত্র ১০০ বা তার অল্প কিছু বেশি কুমির রয়েছে।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলতি বছরের ৩১ জানুয়ারি থেকে বন বিভাগ ও বেসরকারি বন্যপ্রাণী গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন ন্যাচারাল রিসোর্সেস অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (ক্যারিনাম) সুন্দরবনে কুমির গণনা শুরু করে।
খুলনা অঞ্চলের বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. জাহিদুল কবির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, কুমির জরিপের জন্য চারটি ভাগে ভাগ হয়ে গোটা সুন্দরবনে প্রাথমিক তথ্যা-উপাত্ত সংগ্রহ শেষ করেছেন তারা। সংগ্রহ করা তথ্য-উপাত্তগুলো বর্তমানে বিশ্লেষণের কাজ চলছে। বিশ্লেষণ শেষ হলে সুন্দরবনে কুমিরের প্রকৃত সংখ্যা জানা যাবে।
কুমির গণনায় আধুনিক প্রযুক্তি জিপিএস সিস্টেমের ব্যবহার করা হয়েছে। চারটি দলে ভাগ হয়ে জরিপ দলের সদস্যরা ১৩ ফেব্রুয়ারি সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জে গণনার প্রাথমিক কাজ শেষ করে। প্রতিটি দলে ১০ জন করে সদস্য ছিলেন। এসময় তারা বনের অধিকাংশ নদী-খাল ঘুরে কুমিরের অবস্থান, চলাচল, ঘনত্বসহ বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করেন।
গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) ডিভাইজ থেকে সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ শেষে জরিপকালে গোটা সুন্দরবনে কতো কিলোমিটার নদী-খাল ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে তাও জানা যাবে বলে জানান জাহিদুল কবির।
বাংলাদেশ অঞ্চলে সুন্দরবনে জলভাগের পরিমাণ এক হাজার ৮৭৩ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে ছোট-বড় প্রায় ৪৫০টি নদী ও খাল রয়েছে।
কুমির বিশেষজ্ঞ সুন্দরবনের করমজল বন্যপ্রাণী ও কুমির প্রজনন কেন্দ্রের সাবেক কর্মকর্তা আবদুর রব বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সুন্দরবনের জলভাগের পরিমাণ অনুযায়ী অন্তত ছয় থেকে সাত হাজার কুমির বিচরণ করার কথা। কিন্তু সর্বশেষ ১৯৮৫ সালের আইআরএম রির্পোট অনুযায়ী ১৫০ থেকে ২০০ কুমির রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়।
তার ধারণা, বাস্তবে গোটা সুন্দরবনে এখন একশ’র মতো কুমির থাকতে পারে।
‘এস্টুয়ারাইন’ প্রজাতির কুমিরকে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত করে ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্সেস’ (আইইউসিএন) এর রেড বুকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
ক্যারিনাম-এর নির্বাহী প্রধান ড. এস এম এ রশীদ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আমরা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে কুমির নিয়ে কাজ করছি। সুন্দরবনের আয়তন ও জলভাগের হিসাব অনুয়ায়ী হাজার হাজার কুমির থাকার কথা। কিন্তু জরিপের তথ্য বন বিভাগ ও আমাদের হতাশ করেছে।
তিনি আরো বলেন, এবার আমরা এক সঙ্গে চারটি রেঞ্জে কাজ করেছি। এসময় দু’টি বিষয় মোটামুটি পরিষ্কার হয়েছে। প্রথমত, সুন্দরবনের সব এলাকায় এখন আর কুমির নেই। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে বনে প্রাকৃতিকভাবে কুমিরের বংশ বিস্তার মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। তাই সংরক্ষণে এখনই কর্যকর পদক্ষেপ নিতে না পারলে সুন্দরবন থেকে কুমির বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।
জরিপের প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী কুমিরের সংখ্যা ১০০ বা তার কিছু বেশি বলে শোনা গেলেও চূড়ান্ত ফলাফল তৈরির আগে এ বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগর বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, লবণ পানির কুমিরের প্রজনন বৃদ্ধি ও লালন-পালনের জন্য ‘সুন্দরবনস বায়োডাইভার্সিটি কনজারভেশন’ প্রকল্পের আওতায় ২০০২ সালে পূর্ব সুন্দরবনের করমজল পর্যটন কেন্দ্রে আট একর জমিতে দেশের একমাত্র সরকারি কুমির প্রজনন কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
কুমির গণনার সমন্বয়ক ডিএফও মো. জাহিদুল কবির বলেন, জরিপের প্রাথমিক তথ্য গোটা সুন্দরবনে বর্তমানের একশ’ বা তার কিছু বেশি (100 +) কুমির রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে জরিপকালে প্রাপ্ত সব তথ্য বিশ্লেষণের আগে চূড়ান্ত করে এই সংখ্যা বলা যাচ্ছে না।
চলতি বছরের এপ্রিল মাস নাগাদ জরিপের চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে বলেও জানান তিনি।
বন বিভাগ সূত্র বলছে, জরিপের ফলাফলে কুমিরের প্রজনন ও বংশ বিস্তারে কি কি হুমকি রয়েছে তা শনাক্ত করতে হবে। এছাড়া এই হুমকি মোকাবেলায় কি করা যেতে পারে সে ব্যাপারেও বিভিন্ন সুপারিশ করা হবে।
তিনি আরো বলেন, এবারের জরিপ থেকে সুন্দরবনের কুমির সম্পর্কে নতুন নতুন অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে প্রাকৃতিক পরিবেশে কুমির সংরক্ষণের বিষয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া সহজ হবে।
** সুন্দরবনে কুমির গণনা শুরু