সরদার ইনজামামুল হক | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
রাত ৮টা, কুয়াশাচ্ছন্ন দড়াটানা নদী তীরের কলাবাড়িয়া আদর্শ গ্রামে শীতের তীব্রটা একটু বেশিই। শহুরে হিসেবে সময়টা কেবল মাত্র সন্ধ্যা। তবে বিদ্যুতহীন গ্রামটিতে তখনই গভীর রাত। কুয়াশা মাড়িয়ে রাস্তা থেকে অন্ধকার গ্রামটিকে চেনাচ্ছে ছোট ছোট কুপির আলো।
এগিয়ে যেতে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে ভেসে আসছে পড়ার রব। পরিবারের কোন কোন সদস্য ঘুমিয়ে পড়লেও নতুন বই নিয়ে মেতে আছে শিশুরা।
ইংরেজি বছরের প্রথম দিনেই বাগেরহাট সদর উপজেলার বেমরতা ইউনিয়নের নদী তীরবর্তি এই গ্রামটির শিশুরা হাতে পেয়েছে নতুন বই।
দুপুরে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে বাড়ি ফিরে বিকেলে খেলার ঘোরটা কমই ছিল। সন্ধ্যা নামার আগেই বই নিয়ে পড়তে বসার প্রতিযোগিতা ছিলো আজ সবার মধ্যে।
কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে সবাই ব্যস্ত নতুন বই পড়া নিয়ে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে সবার চোখ বইয়ের পাতায়। চোখেমুখে আলোর দ্যুতি।
কলাবাড়িয়া আদর্শ গ্রামের ফারুখ শেখের স্ত্রী শাহানাজ বেগম বলছিলেন, ‘ওগো পড়তি আগে এতো আগ্রহ আর দেহিনি। আমার ছোট ছেলে সাকিব তো আইজ খ্যালা থুয়ে নিজিই আইসে পড়তি বইছে।’
বেমরতা ইউনিয়নের মাদ্রাসা বাজার এলাকার ফতেপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র সাকিব। বছরের প্রথম দিনই সব বিষয়ের নতুন বই হাতে পেয়েছে সে। সন্ধ্যা থেকেই বইগুলো নিয়ে পড়ছে, নেড়ে-চেড়ে দেখছে।
পাশের ঘরে কুপি জ্বালিয়ে পড়ছিল অষ্টম শ্রেণির ফাহাদ ঘরামি। তার কর্মক্লান্ত দিন মজুর বাবা তখন ঘুমিয়ে পড়েছেন। ফাহাদের পাশে বসে এক মনে তার পড়া শুনছেন মা রাবেয়া বেগম।
কথার শুরুতেই তার প্রশ্ন- সবাই বই পাইছে কি না তাই দেখতি আইছেন? আমার ফাহাদ, হালিমা দুইজনই বই পাইছে।
রাবেয়া বেগম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘আইজ তো বই’র পাতা উল্টোটি উল্টোটিই ঘোম পড়িছে হালিমা। ফাহাদ তো এহনও পড়তিছে। অন্য সময় পড়তি চায় না বেশি সময়। নতুন বই পাইয়ে ওগো আগ্রহ বাড়িছে।’
‘সরকার তো এহন আমাগো দিক অনেক চায়। বাচ্চাগুলো এহন ফ্রিতে বই পাইতেছে। আমরা খুব খুশি। গাইড বই কিনতি না হলি আরও ভালো হতো’, যোগ করেন তিনি।
একই গ্রামের ভ্যান চালক ফকরুল জমাদ্দার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘আমাদের কলাবাড়িয়া আদর্শ গ্রাম মূলত ভূমিহীদের গ্রাম। এক দশক আগে দড়াটানা নদীর চরে বিভিন্ন এলাকার ৪০টি ভূমিহীন পরিবারকে ঘর ও জমি বরাদ্দ দেয় সরকার। এই গ্রামের প্রায় ৩০-৩৫ জন আছে স্কুলে পড়ে। এখান থেকে স্কুল বেশ দূরে। তবে ওদের পড়ার আগ্রহ অনেক বেশি। সন্ধ্যা হলেই চ্যারাক (কুপি) চালায়ে পড়তে বসে সবাই।’
দিনমজুর ফারুখ শেখ বলেন, ‘কিছুদিন আগে এখানে বিদ্যুৎ অফিসের লোক খাম্বা (বিদ্যুতের পিলার) দিয়ে গেছে। এহন কারেন্টটা (বিদ্যুৎ) আসলি খুব ভালো হতো। ওগো পড়াল্যাহা করতি সুবিধে হতো।’
বছরের প্রথম দিনেই ধনী-গরিব সব শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে নতুন বই তুলে দেওয়ার সরকারি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষক-অভিভাবকসহ সবাই।
তারা সরকারের এই উদ্যোগকে দেখছেন আগামী দিনের আলোর দ্যুতি হিসেবে।
এইচ/এসআই/বিআই/০২ জানুয়ারি, ২০১৭
** নতুন বইয়ে উচ্ছ্বসিত শিশুরা