সরদার ইনজামামুল হক । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
দেশের ইতিহাসের প্রাচীনতম সড়ক ঐতিহ্য ‘খান জাহান (র.) এর নির্মিত প্রাচীন রাস্তা’।পুরাকীর্তির শহর বাগেরহাটে আবিস্কৃত রাস্তাটি প্রায় সাড়ে ৬শ’ বছর আগে তৎকালীন ‘খলিফাতাবাদ’ নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান নির্মাণ করেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, ‘খানজাহানের প্রাচীন রাস্তা’টি যশোর/বাগেরহাটে অঞ্চল থেকে ‘খলিফাতাবাদ’ নগরীর পাশ দিয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ইট বিছানো পাকা এই রাস্তাটি একই সঙ্গে সেই সময়কার শহর রক্ষা বাঁধ হিসাবেও ব্যবহৃত হত।
দীর্ঘ সময়ে বিস্তৃত প্রাচীন এই রাস্তাটির অধিকাংশ নিদর্শনই হারিয়ে গেছে। তবে এখনও ‘ইট-নির্মিত খান জাহান (র:) এর প্রাচীন রাস্তা ও সেতু’র প্রায় এক কিলোমিটার এলাকা টিকে আছে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাটে’।
সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় দেশের প্রাচীনতম সড়ক নিদর্শনটি সংস্কার কাজে কনজারভেশন আর্কিওলজিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. শফিকুল আলম।
তিনি বলেন, রাস্তা খনন কালে বেরিয়ে আসে ১৫ শতকের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তুসহ কৌতুহল উদ্দীপক কয়েকটি প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ। উন্মোচিত স্থাপত্য কাঠামোর মধ্যে রয়েছে প্রাচীন কালভার্ট, নিরাপত্তা চৌকি, প্রবেশ দ্বার প্রভৃতি।
ষোড়শ শতাব্দীর পূর্ব পর্যন্ত বরিশাল থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত প্রাচীন রাস্তাটির অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তবে পরবর্তিতে প্রবল ভূমিকম্পে প্রমত্তা কীর্তিনাশা পদ্মা নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে অনেক জনপদের ন্যায় প্রাচীন রাস্তাটিও অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে বলে মনে করেন পুরাতাত্ত্বিক গবেষকগণ।
পুরাকীর্তি গবেষক ও বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. গোলাম ফেরদৌস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, পঞ্চদশ শতাব্দিতে খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে খলিফাবাদ নগর রাজ্য গড়ে তোলেন। মধ্যযুগীয় খলিফাতাবাদ নগর আজ বিলুপ্তপ্রায়। অধিকাংশ নিদর্শনই গেল শতকের গোড়ার দিকে ধ্বংস হয়ে গেছে।
‘সাড়ে ৬শ’ বছর ধরে চলাচল উপযোগী দেশের একমাত্র প্রাচীন সড়ক নিদর্শন হিসেবে রাস্তাটি আবিষ্কৃত হওয়ার পর ২০১১ খ্রিস্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার খানজাহান (র:) এর নির্মিত প্রাচীন রাস্তাটি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে।’
প্রাচীন রাস্তার ব্যবহারিক উদ্দেশ্যে সম্পর্কে জানিয়ে গোলাম ফেরদৌস আরও বলেন, মধ্যযুগীয় শহর খলিফাতাবাদের নাগরিক সুবিধা ও নগরের শোভা বৃদ্ধির লক্ষ্যে রাস্তাটি নির্মিত হয়। স্থাপত্য কলার মত রাস্তা নির্মাণেও খানজাহানের অত্যান্ত দক্ষতা ও নির্মাণ কুশলতার পরিচয় ফুটে উঠেছে। অগণিত মসজিদ, জলাধার, সেতু ও সড়ক নির্মাণ করে খানজাহান (রহ.) তার নগরীকে বসবাস উপযোগী অঞ্চলে পরিণত করেছিলেন।
প্রায় সাড়ে ছয়শ বছরের প্রাচীন এই রাস্তা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, ‘বেঙ্গল ডিসট্রিক্ট গেজেটিয়ার’ ও ‘যশোর’ গ্রন্থে। যশোরের বারবাজারে এবং খলিফাতাবাদ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত খানজাহানের প্রাচীন এই রাস্তার কথা উল্লেখ আছে।
‘শের শাহ সুরির আমলে নির্মিত যে ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’কে এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সড়ক হিসাবে বিবেচনা করা হয়, “খানজাহানের প্রাচীন রাস্তা”টি এর চেয়েও প্রায় শত বছর আগে নির্মিত।’
বাজেয়াপ্তি সুন্দরঘোনা থেকে কাঠালতলা পর্যন্ত রাস্তাটি উদ্যোগ নেওয়া হলেও আরও কয়েকটি এলাকায় এই রাস্তার অস্থিত্ব বর্তমান। কাঠালতলা থেকে রনবিজয়পুর পর্যন্ত বর্তমানে যে পিচের রাস্তা রয়েছে, এর নিচেও খানজাহানের রাস্তাটি টিকে আছে। রাস্তার দু’পাশে তা দেখাও মিলে। প্রাচীন রাস্তার টিকে থাকা ওইসব এলাকাগুলোও সংরক্ষণের আওতায় আনা উচিত।
ঐতিহ্য-অন্বেষণ ট্রাস্টের সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, এই রাস্তাটি খানজাহানর আমলের একটি অনন্য নিদর্শন। রাস্তাটি সংরক্ষনে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে আরও যত্নশীল হতে হবে।
এসআইএইচ/বিআই/১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬