প্রচ্ছদ / লেখালেখি / শিল্প-সাহিত্য / গল্প / টানা পোড়েন – ৫ | সুব্রত মুখার্জী

টানা পোড়েন – ৫ | সুব্রত মুখার্জী

স্বামী মারা যাওয়ায় অনিতা পৃথিবীটা অন্ধকার দেখে। ঘরে দুটো ছেলে। বড় ছেলেটা স্কুলে গেলেও ছোটটার বয়স দুই। বাবার আদর কাকে বলে জানল না ছোট ছেলেটা। বেঁচে থাকলেও আদর করার মত ছিল না ওদের বাপ। নেশার আসর থেকে বাড়িতে যতটুকু সময় থাকত চেষ্টা করত সন্তান উৎপাদন করতে।

নেশার টাকা ঠিকমত না পেলে সমস্ত রাগ উঠাত অনিতার শরীরের উপর। সেইদিক থেকে অনিতা মনে করে বেঁচে গেছে। দিন কয়েক যেতে না যেতে অনিতা বুঝতে পারল বেঁচে যায় নি বরং যে শকুন গুলো এতদিন দূর থেকে দেখত, তারা ঘরের পাশে ভিড় জমাতে থাকল। যে শকুন গুলো এতদিন তাদের জাত ভাইয়ের কজি দূর থেকে দেখেছে, জাত ভাই মারা যেতেই দলে দলে আসছে আর বলছে আমাকে দাও।

অনিতার সারাক্ষণ চিন্তা কি করে বাঁচাবে তার ছেলেদের। শ্বশুরের রেখে যাওয়া জমি যা আগেই শেষ হয়েছে থাকার মধ্যে আছে বিঘা খানেক চাষের জমি, একটা পুকুর আর একটা ঘর। বাড়ির চারিপাশে ফাঁকা। একা একা দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতে ভয় করে। রোজই রাতে ঘরের পাশে কারা জানি কথা বলে।

বাপের বাড়িতে নিজের লোক বলতে দুই ভাই। ভাই বউয়ের তাড়নায় ভাইগুলোও অনিতার খোঁজও নেয় না। গ্রামের কুডুর সাথে অনিতার গড়ে উঠে সম্পর্ক। কুডুর বাড়িতে বউ, দুই মেয়ে নিয়ে সুখের সংসার। কুডু বুঝতে পারে না অনিতার এই সম্পর্ক শুধু তার নিরাপত্তা। যখন কুডু বুঝতে পারে তখন তারা অনেক দূর এগিয়েছে।

বিয়ের কথা বলতে অনিতা বলে কি দরকার এই তো ভাল আছে। অনিতা-কুডু বাড়ির পাশের জমিতে ধান লাগায়, সেচ দেয়, ধান কাটে, ধান মলে, পালা দেয়। ধান নিয়ে কুডু বাজারে যায়। কুডু তার সময়ের অধিকাংশ অনিতার বাড়ি কাজ করে। কুডুর সংসার যাতে ঠিকমত চলে অনিতা তার জন্য কুডুকে নিয়মিত কিছু টাকা, চাল, কলা, পেপে দিত।

এভাবেই দুটি সংসারের চাকা ঘুরতে ঘুরতে অনিতার ছেলেরা বড় হতে থাকে। বাড়িতে তালপাতায় হাতে খড়ি, প্রাইমারি স্কুলের গড়া পেড়িয়ে হাই স্কুলে। বড় ছেলে রোজ স্কুল পালায়। অনিতা তাকে মাঠের কাজে লাগিয়ে দিল। বাড়ির মাষ্টার বলে ছোট ছেলের মাথা নাকি অনেক ভাল। ও যদি পড়ে তাহলে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়া ঠেকায় কে? একটু বড় হতেই সেই আগের সমস্যা স্কুল পালান। আর প্রত্যেকদিন চলে অনিতার কঞ্চির পিটান।

অনেক দু:খে কুডুকে অনিতা বলে কি হবে এই পরিশ্রম করে। যারা তার পরিশ্রমের মূল্য বোঝে না তাদের জন্য করে কি হবে? ছেলেরা এখন বড় হয়েছে। লেখাপড়া আর হল না। মাকে কাজ করতে দিতে চায় না। একে একে দুই ছেলে বিয়ে দিয়ে ঘরে বউ আনল। সুখের সংসার। অনিতা এখন সুখী।

রাতে ঘুম আসে না। পাশের বাড়ির রঞ্জন দার বড় ছেলে ডাক্তারি পড়ে। তাকে বলে সারারাত না ঘুমানর কথা। সে বলে পিসি ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমান। ঘুমের ঔষধে ঘুম আসে, কিন্তু ভেসে আসে অনেক কথা পাশের ঘরে ছেলে পুত্রবধুর কথা। পুত্রবধু বলছে, তার শাশুড়ি নাকি বেশ্যা। ছেলে কোন উত্তর দেয় না। বৌমা বলে মান সম্মান বলে কিছু থাকল না সামনের মাসে বাবা-মা আসবে তারা শুনলে কি বলবে। এ কেমন ঘর। এরা ব্রাহ্মন?

সারা রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারে না। মাঝে মাঝে ভাবে আত্মহত্যা করার কথা। কিন্তু আবার চিন্তা করে যেসময় আত্মহত্যা করার সময় ছিল তখন করেনি আবার ভাবে কুডুর হাত ধরে চলে যাবে কিনা। চিন্তা করে কোনদিন তো সে কুডুকে ভালবাসে নি। নিজের প্রয়োজনে ব্যাবহার করেছে বাঁচার তাগিদে।

দিন কাটে রাত কাটে। পুত্রবধুরা কথা বলে না। এমনকি রান্না ঘরে ঢোকা নিয়ে বড় পুতের বউ হাড়ির সব ভাত ফেলে দিয়েছিল একদিন। অনিতা ইচ্ছা করেই রান্না ঘরে যায় না। খাওয়ার সময় না পারলে বাড়ি আসে না। তবে ছোট পুতের বউ একটু ভাল। বিড়ালের মত এক কোনায় কয়টা ভাত রেখে দেয়।

বাড়ির কুকুরটা শীতে কয়েকটা কুটো পায়। এক এক করে তার বিছানার লেপ খাতা গুলো চলে গেছে। বাড়ি আলো করে বড় ছেলের, মেয়ে হয়েছে। দূর থেকে দেখে দেখে একদিন আর না পেরে ছেলের কাছে গিয়ে বলে আমার কোলে একটু দে। ছেলে যেইনা নাতিকে কোলে দিয়েছে কোথায় ছিল পুতের বউ। তার ছোয়াও নাকি পাপ, মুখ দেখাও পাপ। ছেলে পাশে দাড়িয়ে একটা কথার উত্তর দেয় না।

অনিতা বুঝতে পারে না তার পাপ কোথায়? ছেলেদের বাঁচানর জন্য সে কুডু মই করেছে। নিজেকে অনেকের করে দেয় নি এটাই কি পাপ? যদি পাপ হয়, পাপ করেছে। রাতে বড় ছেলেকে ঢেকে বলে, আমার কি পাপ? তোরা কি চাস? ছোট ছেলে দুই পুতের বউ উঠে আসে।

এক সময় মা ছেলের কথা রূপ নেয় ঝগড়ায়। কোন সময়, কোন মুহুর্তে পাশে ছিল বালি কচা তা দিয়ে বাড়ি দেয় বড় ছেলে। অনিতা চোখে অন্ধকার দেখে, পড়ে যায়। বড় ছেলে বুঝতে পারে, মা আর নেই।

দুই ছেলে-দুই পুতের বউ অনিতাকে ধরে নিয়ে যায় পুকুরের পাশে। ধরে ফেলে দেয় পুকুরের পাশে। ঘরে ঢুকে যে যার মত বিছানায় যায়। পরের দিন সকাল বেলায়, সারা এলাকা আত্মীয়দের বাড়ি খোঁজ মাকে পাওয়া যাচ্ছে। একসময় পাওয়া গেল পুকুরে।

তাহলে মনে হয়, মা রাতে পুকুরে গিয়ে পড়ে গিয়ে আর উঠতে পারে নি। মায়ের সৎকার করতে হবে। মা আমাদের একা রেখে কই চলে গেল, আমরা এখন কি নিয়ে বাচব? কাঁদতে কাঁদতে ছেলেরা অজ্ঞান, বউরা কাঁদে আর বলে মা আমাদের অনাথ করে রেখে গেল।

|সুব্রত কুমার মুখার্জী

স্বত্ব ও দায় লেখকের…

About Subrata Mukerjee

উন্নয়ন কর্মী
পূর্বের কারো পৌষ মাস, কারো …
পরের শরণখোলায় বাড়ি ও মন্দিরে ভাঙচুরের অভিযোগ