কথায় আছে, ‘কারো পৌষ মাস, কারো সর্বনাশ’। বাংলায় বহুল প্রচলিত এই প্রবাদটির এক রকম সাদৃশ্য চোখে পড়বে বাগেরহাটের রামপালে।
অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে সরকারি খাল উদ্ধারে অভিযান চলছে এখানে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের সাথে সংযুক্ত রামপাল উপজেলার রেকর্ডীয় সরকারি খালগুলোর অবৈধ বাঁধ অপসারণ শুরু করে প্রশাসন।
প্রভাবশালীদের দেওয়া অবৈধ বাঁধ অপসারণে বুধবার থেকে ফের অভিযানে নামে প্রশাসন। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক নৌ চ্যানেলের সাথে সম্পৃক্ত রামপালের ৮২টি নদী-খালের সকল বাঁধ অপসারণের পরিকল্পনা প্রশাসনের।
| রামপালে ৮২ খালের অবৈধ বাঁধ অপসারণ শুরু
ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানে এরই মধ্যে ৭টি খালে ২৩টি বাঁধ অপসারণ করা হয়েছে।
প্রশাসনের এমন উদ্যোগে সাধরণ মানুষ খুশি হলেও প্রভাবশালী অবৈধ দখলদারদের চোখ ছানাবড়া অবস্থা। কারণ সরকারি নির্দেশে প্রথম দফায় বাঁধ অপসারণের পর তারা আবারও খালে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ শুরু করে। আর এখন বাঁধ কেটে দেওয়ায় তাদের মাছ চলে যাচ্ছে মুক্ত জলাশয়ে।
উপজেলার বাঁশতলী ইউনিয়নের গিলাতলা গ্রামের গাজি নুর মোহাম্মদ (৭৭) বলেন, চিংড়ি চাষের জন্য খালে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ৩০-৪০ বছর আগে খাল গুলো মুক্ত ছিল, কোন বান্দা (বাঁধ) ছিলনা। সবাই মাছ ধরতে পারতো।
বাঁধ কেটে দেওয়ায় জাল নিয়ে স্যাদলার খালে আসা ইসলামাবাদ গ্রামের শেখ ওবাইদুল্যা বলেন, মাছ চাষ শুরু হওয়ায় আমরা তো এহন (এখন) খালের কাছেই আসতে পরিনা। বান্দা কাটা থাকলি তো ভালো হয়। সবাই মাছ ধরতি পারে।
গ্রামে পানিও বাইন্ধা থাহে না। সরকার বান্দা কাটটিছে, তাই জাল নিয়ে আইছি মাছ ধরতি।
তবে আসপাশের ব্যক্তিদের সামনে এমন সাধারণ প্রত্যাশার কথাগুলো অনেকেই বলতে সাহস পাচ্ছিলে না। কেউ কেউ প্রভাবশালীদের শিখিয়ে দেওয়া বুলি বলছিলো।
প্রেক্ষাপট –
গত বছরের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবনের নদীতে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর সবার আলোচনায় আসে মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ পথটি। দীর্ঘদিন খনন না হওয়া এবং শাখা নদী-খালগুলো দখল হয়ে যাওয়া পলি জমে ভরাট হয়ে যায় নৌ পথটি। বাংলাদেশ-ভারত আন্তর্জাতিক নৌ প্রটোকলের অন্তরভূক্ত মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল পূণরায় চালুর লক্ষে ২০১৪ সালের জুলাই-এ খনন কাজ শুরু হয়। কিন্তু শুরু পর থেকে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছিলো খননের সে কাজ।
সুন্দরবনে ট্যাঙ্কার ডুবির পর মংলা সমুদ্র বন্দরের বিপল্প এই নৌ পথটি চালুর জন্য শুরু হয় তোরজড়।
বাঁধ অপসারণে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ –
নৌ চ্যানেলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রামপাল-মংলার সকল রেকর্ডীয় খাল থেকে অবৈধ বাঁধ উচ্ছেদের নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৩ ডিসেম্বর খুলনার বিভাগীয় কমিশনারের উপস্থিতিতে রামপাল সদর ইউনিয়নের ওড়াবুনিয়া খালের বাঁধ কেটে বাঁধ উচ্ছেদের কাজ শুরু হয়।
সে সময় অবৈধ বাঁধ অপসারণের জন্য মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেলের সঙ্গে সংযুক্ত ২৩টি প্রধান খাল চিহ্নিত ও তালিকাভুক্ত করা হয়। কাজও হয় কিছুটা। খালগুলোকে প্রবাহমান করতে কেটে দেওয়া হয় দলখদারদের নির্মিত অবৈধ বাঁধ। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ঝিমিয়ে পড়ে প্রশাসনের ওই অভিযান।
এদিকে, নৌ-চ্যানেলের নব্যতা রক্ষায় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ কর্তৃপক্ষ প্রায় সোয়া দুই শ’ কোটি টাকা ব্যয়ে নিবিড় খনন কাজ করে। খনন কাজ যাতে বাধাগ্রস্থ না হয় সে জন্য চ্যানেলের সঙ্গে সংযুক্ত বিভিন্ন খালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫৯ কোটি টাকার স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ স্থগিত রাখা হয়।
তবু প্রতিশ্রুত চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যে খনন শেষ করা সম্ভব হয়নি।
কিন্তু অবৈধ বাঁধ দিয়ে খাল আটকে চিংড়ি চাষের কারণে খালগুলোতে জোয়ার ভাটার পানি চলাচল করতে না পারায় চ্যানেলটিতে চলমান খনন কাজে বিফলে যাবার শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে।
খালগুলোর বর্তমান অবস্থা –
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার রামপাল উপজেলায় দুই শতাধিক রেকর্ডীয় খাল রয়েছে। এ সব খালের অধিকাংশই অবৈধ দখলদারদের দখলে। যার একটি বড় অংশ ভরাট হয়ে গেছে। বাকি গুলোতে বাঁধ দিয়ে আটকে মাছের চাষ করছেন প্রভাবশালীরা।
খাল খননে প্রধানমন্ত্রীর পুণনির্দেশ –
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কঠোর নির্দেশে বুধবার থেকে আবারও মাঠে নামে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসন।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, দ্বিতীয় দফায় পূর্বের তালিকাভুক্ত ২৩টি খাল ও তার বিভিন্ন শাখা-উপশাখা মিলে উপজেলার মোট ৮২টি খাল চিহ্নিত করা হয়েছে।
এরই মধ্যে অভিযান শুরু দু’দিনে উপজেলার চারটি ইউনিয়নের ৭টি খালের ২৩টি বাঁধ অপসারণ করেছে ভ্রাম্যমান আদালত।
রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) রাজিব কুমার রায় বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, সকল খাল ও খালে নির্মিত অবৈধ বাঁধ অপসারণ না হওয়া পর্যন্ত এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
বাঁধ অপসারণের কারনে এলাকার সাধরণ মানুষ খুশি হলেও সুবিধাভোগীদের মধ্যে বাঁধ কাটায় ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ও জনপ্রতিনিধিদের অধিকাংশ প্রকাশে না হলেও এই বাঁধ রাখার পক্ষে বলে জানা গেছে।
রামপালের বাঁশতলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, কেবল বাঁধ অপসারণই নয়, খালগুলোতে দ্রুত খনন প্রয়োজন। তা ছাড়া জোয়ারের পানি থেকে এলাকাবাসিকে রক্ষা করতে স্লুইজ গেটগুলোও নির্মাণ করা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন।
উপজেলার গিলাতলা গ্রামের হওলাদার ফরিদ হোসেন ক্ষোভের সাথে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘রামপাল ও মংলার কিছু লোক পরের জমি ও সরকারি খাল আটকে বাঁধ দিয়ে খাতি খাতি জি (জিহবা) লম্বা হয়ে গেছে। তারা মাইনষের (মানুষের) জমি দখল করে খালিও হারির টাকা (জমির ভাড়া) দেয় না। এখন সরকার বাঁধ কাটলিও তানারা দাড়ায় দ্যাহা (দেখা) ছাড়া কিছু করতি পারতিছে না।’
তবে বাঁশতলী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক এবং ৪নং ইউপি সদস্য গাজি আলমগীর হোসেনসহ অনেকেই মনে করেন, স্যাদলার খালে বাঁধ না থাকলে এলাকা জোয়ারের পানিতে প্লাবিত হবে।
আলমগীরের দাবি, ‘৩০ বছর বছর ধরে এই খালে (স্যাদলার খাল) বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা হচ্ছে। এতে বরং মানুষ জোয়ারের পানির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে।’
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. জাহাংগীর আলম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, ইতিপূর্বে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল সংলগ্ন মংলা ও রামপাল উপজেলার ২৩টি খালের দুই শতাধিক অবৈধ বাঁধ উচ্ছেদ করেছিলো জেলা প্রশাসন। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যক্তি ওইসব খালে আবার বাঁধ দিয়েছেন।
সরকারী রেকর্ডভুক্ত এসব খালের নব্য ফিরিয়ে আনতে সেখানে স্থাপিত সব অবৈধ বাঁধ অপসারণ না করা পর্যন্ত এই অভিযান চলবে।
তিনি আরও বলেন, রামপালের ৮২ টি সরকারি রেকর্ডীয় খাল খননের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ জন্য একটি প্রকল্প চুড়ান্ত করা হয়েছে। বরাদ্দ পেলে রেকর্ডীয় খালগুলোর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে খননের কাজ শুরু হবে। একাজে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে পাশে চান তিনি।