পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শ্বাসমূলীয় বন সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগর উপকূলে বনের পাশের ছোট্ট দ্বীপ দুবলার চর। সাগর তীরের কুঙ্গা ও মরা পশুর নদীর মোহনায় জেগে ওঠা এ চরে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে রাস মেলা।
হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীরা পুণ্যস্নানের জন্য এ সময়ে চরে আসেন দলে দলে।
গহীন অরণ্যের পাশে নয়নাভিরাম এ দ্বীপে দাড়িয়ে সাগরের সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য অতীব চমৎকার। এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে চরতে দেখা যায় চিত্রল হরিণের দল। পর্যটকদের মনকে রূপময় করে তুলে এ চরের বৈচিত্র।
প্রতি বছরই কার্ত্তিক-অগ্রহায়ণের শুক্লপক্ষের ভরা পূর্ণিমায় সাগর যখন উছলে ওঠে, লোনা পানিতে ধবল চন্দ্রালোক ছলকে যায় অপার্থিব সৌন্দর্য রচনা করে, চন্দ্রিমার সেই আলোকমালায় সাগর-দুহিতা দুবলার চরের আলোর কোল মেতে ওঠে রাস উৎসবে।
দুবলার চরের রাসমেলার ইতিহাস বেশ পুরানো। এ নিয়ে নানান কাহিনিও প্রচলিত আছে।
• যেভাবে সূচনা রাসমেলার:
কথিত আছে, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে এক হিন্দু সাধু এই মেলা শুরু করেছিলেন। তিনি চব্বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে গাছের ফল-মূল খেয়ে অলৌকিক জীবন-যাপন করতেন।
অন্য একটি মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ শত বছর আগের কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পুণ্যলাভে গঙ্গাস্নানের স্বপ্নাদেশ পান।। সেই থেকে শুরু হয় রাসমেলার।
আবার কারও কারও মতে, শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ উপলক্ষ্যেই দুবলার চরে পালিত হয়ে আসছে রাস উৎসব।
• কী হয় মেলাতে :
যেখানে সাগরের ঢেউয়ের গর্জন আর বনের হিরণ্ময় নিস্তব্ধতা ছাড়া কিছুই নেই। সেই সাগরের চর তিনদিনের রাস উৎসবে মাতোয়ারা হয়ে ওঠে। ভরে যায় আলোয় আলোয়। হিন্দু নর-নারী এ মেলাকে গঙ্গাসাগরের মতো তীর্থস্থান মনে করে। লাখ লাখ ভ্রমণবিলাসী মানুষ সুন্দরবন এবং সাগরদর্শনে আনন্দ উপভোগের জন্য আসেন এখানে।
সমুদ্র কোলে পাঁচ মাইল প্রশস্ত বালুকাবেলায় পদব্রজে ভ্রমণ করেন। সৌন্দর্য পিপাসুদের ক্যামেরায় বন্দী হয় আশ্চর্য সুন্দর সব চিত্র। তীর্থযাত্রী ভ্রমণকারীরা নৌকায় রান্না ও আহার এবং বালুচরে ঘুরে বেড়ান। সেই সাথে এই ৩ দিন বনের ভিতরে নির্ভয়ে চলাফেরা করে মেলায় আগত মানুষ। শত শত নৌকা-ট্রলার ও লঞ্চের সমাগমে স্থানটি সজ্জিত হয়ে ওঠে আলোর ঝলকে।
বিভিন্ন রকম হস্ত ও কুটির শিল্প সামগ্রীর সমাগমও ঘটে এ মেলায়। হিন্দুদের নানান পূঁজা-অর্চনার ফাঁকে সন্ধ্যায় ওড়ানো হয় ফানুস। মেলার মূল প্রার্থনা হয় ভোরে প্রথম জোয়ারে পুণ্য স্নানের মধ্য দিয়ে।
এদিন সূর্য ওঠার আগেই দুবলার চরের আলোরকোল সমুদ্র সৈকতে প্রদীপ জ্বালিয়ে প্রার্থনায় বসেন পুণ্যার্থীরা। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্রেও জোয়ার শুরু হয়। জোয়ারের পানি পুণ্যার্থীদের ছুঁলেই স্নানে নামেন তারা।
• প্রকৃতির রূপবৈচিত্র্য দর্শন :
সুন্দরবনকে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অজস্য সামুদ্রিক স্রোতধারা, কাদার চর ও ম্যানগ্রোভ বনভূমির অপরূপ সৌন্দর্য। পুরো বনেই নদীনালা, সুন্দরবন খাড়ি, বিল মিলিয়ে রয়েছে অসংখ্য জনাকীর্ণ অঞ্চল। নানা প্রজাতির পাখি, চিত্রা হরিণ, কুমির ও সাপসহ অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল সুন্দরবন। নদীতে কুমির ও ভয়াল অজগরসহ প্রায় ৩৩ প্রজাতির সরীসৃপ আছে এখানে।
দুবলার চরে দেখা মেলে হরিণের পাল। আছে বানর, মদনট্যাক, মাছরাঙ্গা। ভাগ্য থাকলে পেয়ে যেতে পারেনবাঘের পদচিহ্ন।
রাসমেলা ছাড়াও দুবলার চরে দেখতে পাবেন জেলেদের শুঁটকি তৈরি। পুরো দুবলার চরজুড়েই এসময়ে শুঁটকি তৈরি করেন জেলেরা।
• সুন্দরবনের আকর্ষণ :
বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। ক্যামেরার সাহায্যে বন্য জন্তুর ছবি তোলার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে পৃথিবী বিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ ছাড়াও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর দর্শন সহজলভ্য।
• কীভাবে যাবেন :
নিজস্ব উদ্যোগে সুন্দরবনের গহীনে ভ্রমণ কঠিন। তাই রাসমেলা ছাড়াও সুন্দরবনে ভ্রমণে যেতে সাহায্য নিতে হবে অভিজ্ঞ কোনো ভ্রমণ সংস্থার। রাস উৎসব উপলক্ষ্যে সুন্দরবনে বিশেষ প্যাকেজের ব্যবস্থা করে বেসরকারী ভ্রমণ সংস্থাগুলো।
ঢাকা বা দেশের যে কোন প্রান্ত থেকে বাসে সরাসরি খুলনা বা বাগেরহাটের মংলা যেতে পারবেন। এরপর মংলা বন্দর বা খুলনা নতুন বাজার লঞ্চঘাট থেকে সুন্দরবন যাওয়া যায়। সুন্দরবন যেতে প্রাইভেট মোটর, লঞ্চ, স্পিডবোট, নৌকা বা মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের যান ভাড়া করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
এ ছাড়া ঢাকা থেকে বিমানে যশোর, সেখান থেকে সরাসরি খুলনা-মংলা কিংবা সদরঘাট থেকে রকেটে ও লঞ্চে করে আসতে পারেন।
হিরণ পয়েন্টের মংলাপোর্টে ত্রিতল বিশিষ্ট রেস্টহাউস রয়েছে। একসঙ্গে ৮ জনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে এসব রেস্টহাউসে। এ জন্য খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তার অফিস থেকে অনুমোদন নিতে হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন টুরিস্ট কোম্পানিগুলো নিজেদের লঞ্চ ও জলযানে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকেন।
রাসমেলায় আসা পর্যটকরা এ সময়ে কোকিলমনি, তিনকোণা দ্বীপ এবং নীলকমলসহ সুন্দরবনের অসাধারণ কয়েক জায়গাও ঘুরে যেতে পারবেন।
মেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ভারত, আমেরিকা, মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশের বিদেশি পর্যটকদের আগমন ঘটে।
- সুন্দরবনের ‘বনবিবি’ পূজা
- ‘করমজল’ ইকো-ট্যুরিজম কেন্দ্র
- ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ
- কোদলার প্রাচীন অযোধ্যা মঠ
- শেকড়ের সন্ধানে