অনুসন্ধানে জানা গেছে, চোরা কাঠুরিয়ারা প্রতিদিন সুন্দরবন থেকে বিপুল পরিমাণ সুন্দরী, পশুর বাইনসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে পাচার করছে। ফলে খাদ্য ও আবাসন সংকটে পড়েছে বন্য প্রাণীরা। অপর দিকে বনের কোল ঘেষা ভোলা নদী ভরাট এবং গহীন বণের শাখা খাল গুলো শুকিয়ে যাওয়ায় পানিতে বাড়ছে লবনাক্ততা।
আর তাই খাদ্য ও মিঠা পানির খোঁজে বনের মায়াবী চিত্রল হরিণ চলে আসছে লোকালয়ে। ঢুকে পড়ছে সুন্দরবন সংলগ্ন পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলোতে। আর এ সুযোগে বেপড়োয়া হয়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চোরা শিকারীরা।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে সুন্দরবনের গুলিশাখালী ফরেষ্ট ক্যাম্প কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা এক ব্যক্তি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের আমুরবুনিয়া, জিউধরা, গুলিশাখালী, ধানসাগর ফরেষ্ট ক্যাম্প এলাকায় বহিরাগত ছাড়াও স্থানীয় একাধিক চিহ্নিত সংঘবদ্ধ চোরা শিকারীরা দীর্ঘ দিন ধরে হরিণসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণী শিকার করে আসছে। এসব শিকারীরা সাধারণতা গুলি করে ও অথবা ফাঁদ পেতে শিকার করে।
অপর আর একটি সূত্র জানায়, কোচিখালী অভয়ারণ্যসহ ডিমের চর, বাইসের ছিলা, আউড়াবয়া, ধানসাগর, গুলিশাখালী ও তেতুঁলবাড়ীয়া খাল এলাকায় আশংকাজনক ভাবে বেড়েছে চোরা শিকারীদের আনাগোনা। প্রায় প্রতিদিনই শিকারীদের হাতে মারা পড়ছে মায়াবী চিত্রল হরিণসহ অসংখ্য বন্য প্রাণী।
বনরক্ষী অথবা আইন শৃংখলা বাহিনীর বিশেষ অভিযানে মাঝে মধ্যে ধরাও পড়ছে এসব চোরাশিকারীদের কেউ কেউ। তবে গ্রেপ্তার হলেও আইনের ফাঁক-ফোঁকড় গলে কিছু দিনের মধ্যে মুক্ত হয়ে আবারও তারা স্বদর্পে ফিরে আসছে পুরানো পেশায়।
তবে, সবসময়ই ধরাছোয়ার বাইরে থেকে যায় মূল হোতারা।
বছরে কত হরিণ মারা হয়? এমন প্রশ্ন অনেকের।
এ নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে ওয়াইল্ড লাইফ ট্রাস্ট অব বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা। তাদের জরিপ বলছে – বছরে ১১ হাজারের বেশি হরিণ নিধন হচ্ছে। ২০১১ সালে সংস্থাটি সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জে হরিণ শিকার নিয়ে জরিপ চালায়। জরিপের সময় সংস্থাটি বছরে ১১ হাজার ১৯৫টি হরিণ শিকারের তথ্য পায়। এ জরিপে সহায়তা করে ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও লন্ডনের জিওলজিক্যাল সোসাইটি। জরিপটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে বলে দাবি সংস্থার।
অবশ্য বন বিভাগের দু’জন পদস্থ কর্মকর্তাও হরিণ শিকারের এ পরিসংখ্যান ‘প্রায় সঠিক’ বলে অভিমত দিয়েছেন। কিন্তু তাঁরা নিজেরা শিকারের কোনো তথ্য দিতে পারেনি।
তবে, সুন্দরবন অঞ্চলে বন বিভাগের দুটি শাখা ও কোস্টগার্ড যে হিসাব দিয়েছে, তাতে বছরের গড়ে ১০০ হরিণের মাংস, মাথা বা চামড়া উদ্ধার করা হয় চোরা শিকারিদের হাত থেকে। কিছু শিকারিও গ্রেপ্তার হন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে পরিচালিত ‘সুন্দরবনের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য নিরাপত্তা’ প্রকল্পের একটি প্রকাশনায় বলা হয়েছে, সুন্দরবনে প্রায় আড়াই লাখ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী আছে। এর মধ্যে হরিণই আছে দেড় লাখের মতো। সবই সুন্দর চোখের অধিকারী চিত্রা হরিণ। আর এই হরিণ শিকারকে কেন্দ্র করেই সুন্দরবনের চারদিকে গড়ে উঠেছে সংঘবদ্ধ চক্র।
সুন্দরবন (বাংলাদেশ অংশে) দেখভালের জন্য বন অধিদপ্তরের দু’টি বিভাগ রয়েছে। একটি খুলনা ও সাতক্ষীরা নিয়ে (সুন্দরবন পশ্চিম), অন্যটি খুলনার অংশ ও বাগেরহাট নিয়ে (সুন্দরবন পূর্ব বিভাগ)। দুই বিভাগের অধীনে আছে চারটি বন অঞ্চল, এতে এক হাজার ১৬৭ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন।
বনজীবীদের কাছে জানা গেছে, চোরা শিকারিরা জেলে বা বাওয়ালি সেজে ছোট নৌকা নিয়ে দু-তিনজনের ছোট দলে বনের গহিনে প্রবেশ করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তারা ফাঁদ, বিষ, টোপ এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে হরিণ শিকার করে। মারার পর বনের ভেতরেই ছিলে কেটে চক্রের এজেন্টদের মাধ্যমে ৪০০-৫০০, ৬০০ টাকা কেজি দরে মাংস বিক্রি করে। পরে শিকার করা হরিণ কৌশলে আশপাশের লোকালয়ে আনা হয় এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার করা হয়।
আর সবচেয়ে বেশি হরিণ শিকার করা হয় রাসমেলাকে কেন্দ্র করে। এ সময় তীর্থযাত্রীর ছদ্মবেশে হরিণ শিকারিরা বিপুল পরিমাণে হরিণ শিকার করে।
এ ব্যাপারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল এইচ খান বলেন, চোরা শিকারিরা সুন্দরবন থেকে হরিণ মারছে এটা সত্যি। কিন্তু ওই গবেষণায় যেভাবে বছরে ১১ হাজার হরিণ শিকার করার কথা বলা হয়েছে তা আমার কাছে সঠিক মনে হয় না। কেননা, বন বিভাগ এবং আমার নিজের গবেষণায় দেখা গেছে সুন্দরবনে হরিণের সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ হাজার। বছরে ১১ হাজার মারা গেলে এত দিনে সব হরিণ শেষ হয়ে যেত।
তাই উদ্যোগী হতে হবে এখনই। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি গড়ে তুলতে হবে স্বচেতনতা৷তা না হলে রক্ষা পাবে না আমাদের সুন্দরবন।