সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যাওয়া তেলবাহী ট্যাঙ্কার থেকে ক্ষতিকর তেল ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের অন্তত ৩৪ হেক্টর জুড়ে।
সাড়ে ৩ লাখ লিটারেরও বেশি তেল নিয়ে ডুবে যাওয়ার পর তিনদিনে যার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এখানকার জীববৈচিত্রে।
বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী এবং সংলগ্ন লোকালয়ের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার দুপুরে ফার্নেস অয়েলবাহী ট্যাঙ্কারটি উদ্ধার হলেও এরই মধ্যে এ তেল ছড়িয়ে পড়েছে বন এবং বনসংলগ্ন এলাকাগুলোতে।
বিস্তীর্ণ এলাকার নদী খাল জুড়ে এখন শুধু তেল আর তেল। বাতাসে তেলের গন্ধ। তেলের আস্তরণের কারণে মাছ ধরতে পাছেন না জেলেরা।
তাছাড়া বিশুদ্ধ পানির সংকটে থাকা সুন্দরবনের শ্যালা নদী সংলগ্ন লোকালয়ের মানুষও এখন আর ব্যাবহার করেত পারেছ না এ পানি। বনের ভেতরে গাছপালাতেও শুরু করেছে এর প্রভাব পড়ছে।
দুর্ঘটনাস্থল সংলগ্ন বাগেরহাটের মংলা উপজেলার চিলা ইউনিয়নের জয়মনি গ্রামের পল্লীচিকিৎসক আবু জাফর হাওলাদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, জোয়ার ভাটার ফলে গত দু’দিনে তেল সুন্দরবন ছাড়াও লোকালয়ের ছোট ছোট খালগুলোতে ঢুকে পড়েছে।
এতে এমনিতেই নিরাপদ পানি সংঙ্কটে থাকা উপকূলীয় এ এলাকার মানুষের এখন গোসল, খাওয়া-দাওয়ার জন্য বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। জোয়ারের সময় পানিতে মিশে এ তেল ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের গ্রামের মৎস্য ঘেরগুলোতে।
সুন্দরবন সংলাগ্ন এলকার মানুষের মাঝে বন রক্ষায় সচেতনতা বৃদ্ধিতে ক্রেল প্রজেক্টের আওতায় গঠিত পিপলস্ ফোরামের সদস্য রনি গাজি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, তেল ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে। গ্রামের খালের পানিতেও এখন ভাসছে বিষাক্ত কালো তেল।
ফলে, পানিতে নামতে পারছে না গবাদি পশু-পাখিও। তাদের গ্রামে পাশের খালে নেমে মারা গেছে ৬টি হাঁস ও গুইসাপ। পানি খেয়ে অসুস্থ হয়েছে দুটি গরু।
তিনি জানান, পানি নষ্ট হওয়ায় গোসল, খাওয়াসহ অন্যান্য কাজে লাগাতে পরছে না এখানকার মানুষ।
সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া স্থানীয় জেলেদের বরাত দিয়ে তিনি জানান, গত তিনদিনে তেলের কারণে নদীতে মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। অনেক জায়গায় মাছ মরে ভেসে উঠেছে।
মো. রিপন হাওলাদার নামে স্থানীয় এক চিংড়ি চাষি বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, বৃহস্পতিবার থেকে জোয়ারের সময় শ্যালা নদীর তেল মিশ্রিত কালো পানি ছোট খাল দিয়ে ঢুকে পড়েছে তাদের চিংড়ি ঘেরে। এরই মধ্যে চিলা ইউনিয়নের জয়মনি, সুন্দরতলা, কাটাখাল পাড়, বদ্যমারী, গিলেখাল, চিলাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত খালগুলোতে ডুকে পড়েছে কালো তেল মিশৃত পানি। এসব খাল দিয়ে বিশাক্ত পানি ডুকে পড়ছে চিংড়ি ঘেরে।
এ কারণে এখানকার চিংড়ি চাষিরা ব্যাপক ভাবে ক্ষতির আশঙ্কা করছেন।
খুলনার বন সংরক্ষক কার্তিক চন্দ্র সরকার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, তেল ছড়িয়ে পড়ায় বনসহ গোটা পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যে এলাকায় ট্যাঙ্কারটি ডুবে গেছে সেটি ডলফিনের অভয়ারণ্য।
এতে ডলফিন-ইরাবতি, কুমিরসহ বিভিন্ন জলজ প্রাণী ও গাছপালার যে ক্ষতি হয়েছে তা অপূরণীয়।
সুন্দরবনের এটাই প্রথম তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির ঘটনা। এর আগে চলতি বছরের ২৪ নভেম্বর ভোরে এই নদীতে ডুবে যায় যাত্রীবাহী নৌযান এমভি শাহীদূত। অবশ্য সে সময় অবশ্য লঞ্চে যাত্রী ছিল না। ডুবে যাওয়া সে লঞ্চটিও উত্তোলন করা হয়নি এসময়ে।
এদিকে, চট্টগ্রাম থেকে রওয়ানা হওয়া নৌবাহিনীর টাগবোট কান্ডারি-১০ ঘটনা বিকালে ঘটনাস্থালে পৌঁছেগেছে বলে জানিয়েছেন মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কেএম আকতারুজ্জামান।
তবে পৌঁছালেও এখনই পানির ওপর থেকে তেল দূর করতে কাজ শুরু করছে না কান্ডারী-১০।
মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এই টাগবোটে ১০ হাজার লিটার তেলের দূষণ কমানোর মতো ‘অয়েল স্পিল ডিসপারস্যান্ট’ রয়েছে। যা ছিটালে ভেসে থাকা তেল পানির নিচে চলে যাবে এবং পানির অক্সিজেন নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা কমবে।
এদিকে, বন বিভাগের কর্মকর্তার ধারণা, ওটি সাউদার্ন স্টার-৭ এ থাকা সাড়ে তিন লাখ লিটারেরও বেশি ফার্নেস অয়েলের প্রায় পুরোটাই ইতোমধ্যে সুন্দরবনের নদী ও খালে ছড়িয়ে পড়েছে। শেলা নদীর মৃগমারী, আন্ধারমানিক, তাম্বুলবুনিয়া, হরিণটানা, শুয়ারমারা, জিউধরা, ধানসাগর, নন্দবালা, হারবাড়িয়া, চাঁদপাই স্টেশন কার্যালয়, মরাপশুর, জংড়া, করমজল বন্যপ্রাণী প্রজনন কেন্দ্র, ঢাংমারী, ঘাঘড়ামারী, লাউডোব এবং এর আশপাশের এলাকার পানিতে ভাসছে এ তেল। জোয়ারের সময় এ তেল ছড়িয়েছে বনের ভেতরে বিস্তৃণ এলকাতেও।
তেল ছড়িয়ে পড়া এলাকাটি সরকার ঘোষিত ডলফিনের অভয়ারণ্য। তাছাড়া সুন্দরবন জাতিসংঘ ঘোষিত বিশ্বের গুরুত্বপূণ জলাভূমি এবং সংস্থাটির শাখা ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্য। তাদের নিয়ম অনুযায়ী নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ সুন্দরবনের ভেতর এই শ্যালা নদী ও এ এলাকায়।
কিছু দিন আগেও জাতিসংঘের জলাভূমি বিষয়ক সংস্থা রামসার এই নৌপথটি নেয়ে আপত্তি জানায়। আহ্বান জানায় নৌপথটি বন্ধে ব্যবস্থা নিতে। সংস্থাটির পক্ষ থেকে এরই মধ্যে লিখিত বিবৃতি দিয়ে সুন্দরবনে তেল ছড়িয়ে পড়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান শামসুজ্জোহা খন্দকারের সভাপতিত্বে সভায় স্থানীয়দের সহায়তা নিয়ে আগামী তিন দিনের মধ্যে তেল অপসারণের একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে কাজ শুরু করবে কান্ডারি-১০।
অন্যদিকে নৌবাহিনী শ্যালা নদী দিয়ে নৌযান চলাচল নিয়ন্ত্রণে যথাযথ তদারকি শরু করেছে বলে সন্ধায় এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান হয় আরো ফার্নেস ওয়েল যাতে নদীতে ছড়াতে না পারে এজন্য নৌবাহিনীর জাহাজ ‘শহীদ আখতার উদ্দিন’ ও ‘শাহ পরাণ’ ডাইভিং এবং স্যালভেজ টিমসহকারে ঘটনাস্থল ও আশেপাশে এলাকায় বাঁশ ও রাবারের ফ্রেম দিয়ে বুম তৈরী করছে।