স্কুলবেলা

• মেহেদী হাসান সোহেল

বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে আমি গর্বিত। এই স্কুলের সান্নিধ্যে আমার বেড়ে ওঠা (বাসা যেহেতু স্কুলের পাশে)। বাবা-মার কাছে শুনেছি, আমি নাকি যখন ভাঙা ভাঙা কথা বলতে শিখেছি মাত্র তখন থেকেই সাত্তার(সরকারি) স্কুলে পড়তে চাইতাম।

তবে সেই মহেন্দ্রক্ষন আসে আমি যখন ক্লাস থ্রি পাস করে, স্কুলের ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। স্কুলে বরাবরই দশের মধ্যে আমার রোল থাকত। তা সত্বেও অজ্ঞাত কারণে এসএসসি’তে আশানুরূপ ফল হয়নি। তারপর পড়াশুনার প্রতি একটা অজানা ক্ষোভ চলে আসায় এইচএসতিতে ফলাফল আরও অবনমন হয়। পরবর্তীতে ঢাকায় প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হই। সেখানে পড়ার মাধ্যম ENGLISH. তখন আমাদের মত মফস্বলের ছেলেদের ইংলিশের নাম শুনলে হাত-পা কাপে। তবু আত্মবিশ্বাস হারাইনি বরং নিজেকে ফিরে পাবার জন্য যুদ্ধ শুরু করলাম। আর যুদ্ধের পাথেয় ছিল আমার প্রাণপ্রিয় শিক্ষকদের শিক্ষা আর অনুপ্রেরণা।

সুনীল স্যার, জলিল স্যার আর জহুরুল হক স্যারে কাছ থেকে ইংলিশের হাতেখড়ি হয়েছিল তাই হলো পাথেয়। সুনীল স্যারের কাছের আমি চিরকৃতজ্ঞ, কারণ তার কাছেই প্রথম জেনে ছিলাম, প্যারাগ্রাফ মুখস্থ না করে লেখা যায়।

শ্রদ্ধেয় শিক্ষকগন Tense, Voice Change, Narration আর Translation-এর মাধ্যমে আমাদের ইংরেজির যে ভিত দাড় করিয়ে দিয়েছিলেন তার উপর ভর করে ‘বিবিএ’ আর ‘এমবিএ’ পার দিলাম। আমরা আসলে সৌভাগ্যবান কারণ গণিতে পেয়ে ছিলাম অমেলেন্দু স্যার, কিরন স্যার, তরুন স্যার, সুবল স্যার আর গুরু দেবাশীষ স্যারের মতো বাঘা শিক্ষক।

দেবাশীষ স্যারের কাছে পড়েছি দীর্ঘদিন। তবে আমাদের সময়ের প্রাইভেট বর্তমান সময়ের মত ঘণ্টা চুক্তি ছিলনা। অংক শুরু হলে শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার বাসা ছাড়ার উপায় ছিল না। স্যার অংক বুঝয়ে দিত শেষ করতে আমাদের। মাঝে মাঝে স্কুলে যাবার সময় চলে আসত তাই অনেকে সেই যাত্রা রক্ষা পেত। আমাকে কখনো এরকম বসে থাকতে হয়নি তবে মেয়েদের সাথে একসাথে পড়তাম, তাই না পাড়ার ভান ধরে বসে থাকতাম। তবে ধরা খেলে জামিন নাই।

» প্রাণের মাঝে আয়…

আমার হাতের লেখা ছিল খুবী খারাপ। যা পড়া খুবই দুষ্কর ছিল। হাতের লেখার ব্যাপারে প্রথম টিপস দিয়ে ছিল মুজিবর স্যার। এত ছাত্রের মাঝে স্যার প্রায়শই কাছে গিয়ে দেখিয়ে দিতেন কিভাবে লাইন সোজা করে লিখতে হয়। ইংলিশের শুরুটাও তার হাত ধরে।
হাতের লেখা ভাল করার পিছনে বড় অবদান শাহাব স্যারের। ওনার সান্নিধ্যে যে কারো হাতেরলেখা ভাল হতে বাধ্য। বড় সুবল স্যারের কাছে শিখে ছিলাম, অবলীলায় সুন্দর করে কোন ঘটনার বিবরণ কিভাবে দিতে হয়। যা আমার প্রফেশনে খুবই কার্যকরী ভূমিকা রাখছে। সোলায়মান স্যারের আর হাসিনা আপার সমাজপাঠ আমাকে ইতিহাসের প্রতি অনুরক্ত করেছে। নওশের স্যারের ভুগোলপাঠ আমাকে মানচিত্রের মাধ্যমে দেশ-বিদেশ চেনার আকাঙ্ক্ষাকে জাগ্রত করে। ধর্মের অনুশাসন শিখেছি ছোট হুজুর স্যার আর বড় হুজুর স্যারের কাছে। প্রিয় মোক্তার স্যার যে আমাদের বুজিয়েছে ‘আদর করা তারি সাজে, শাসন করে যে’। সেদিন না বুঝলেও আজ বুঝি স্যার আমাদের কতটা আদর করত। টেস্ট পরীক্ষার পর সব ছাত্রদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খবর নিতেন স্যার।

আমার জীবনে রেনেসাঁ ঘটে শহীদুল্লাহ স্যারের মাধ্যমে। আমি ছিলাম নিরীহ, গোবেচারা, ভেগাবন্ড টাইপের মায়ের আঁচল ধরা ছেলে। সেই ছেলেকে ক্লাস ফাইভে পড়াকালীন সময় স্যার বলল, তোকে বিজয় দিবসে শরীরচর্চায় অংশ নিতে হবে। প্রথমে রাজী ছিলাম না কিন্তু রাজী না হয়ে উপায় ছিলনা, কারণ মাঠে না নামলে শরীর চর্চায় ফেল করিয়ে দিবে। বাধ্য হয়ে অনুশীলন শুরু করলাম। এরপর স্যার যা বললেন তাতে ভয়ে দম বন্ধ হবার অবস্থা। আমাকে নাকি প্যারেডের সময় ‘গাইড’ মানে সামনে থাকতে হবে।

ঐবার আমরা প্যারেডে প্রথম হলাম। প্রথম হওয়া স্কুলে জন্য মামুলী বিষয় হলেও আমার জন্য তখন বিশাল ব্যাপার ছিল। তারপর থেমে থাকতে হয় নাই। শাহাব স্যার, জুয়েল ভাই, মহিউদ্দিন ভাই আর আকরাম স্যারের হাত ধরে কাব স্কাউটের সকল ইভেন্টে অংশ নেওয়া।

একসময় মনে হত আমরাই (আমি ও আমার বন্ধুরা) স্কুলের কাব-স্কাউটস্। নেতৃত্বের হাতেখড়ি সেখান থেকেই। এখনও কর্মস্থলে ছোটখাটো টিমের নেতৃত্ব দেই, যার সবই স্যারদের অবদানের জন্য। ব্যক্তিত্ব কাকে বলে সেই স্কুল জীবনে জেনেছি ইনামুল হক স্যারের কাছ থেকে। বারেক স্যার, মতিয়ার স্যার, দবির স্যার, আকিল স্যার, সুলতান স্যার, পণ্ডিত স্যার সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

প্রিয় স্কুলের ৭০ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে পুনর্মিলনীতে যখন সবাই মিলে জাতীয় সংগীত আর শপথ পাঠ করি, তখন চোখ ভিজে আসছিল; মনে পেড়ছিল স্কুলজীবনের কথাগুলো। এই কটাদিন যেন ফিরে গিয়েছিলাম ছাত্র জীবনে। তাই লিখে একটা মুহুর্ত নষ্ট করতে চাইনি।

আমি আমার অগ্রজ-অনুজদের কাছে, বিশেষ করে পুনর্মিলনী কমিটি কাছে, কৃতজ্ঞ; আপনারা আবার জানিয়ে দিলেন আমরা পারি। সকল প্রাক্তন এবং বর্তমান ছাত্রদের কাছে অনুরোধ আমরা এমন কিছু করবনা যাতে আমাদের এই ৭০ বছরের অর্জন মাটিতে মিশে যায় না। কারণ এই অর্জনের পিছনে আমাদের অগ্রজ, শিক্ষক, সহপাঠী ও অনুজদের কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে।

আমরা সব কিছুতে শ্রেষ্ঠ হব শিক্ষা, খেলায়, সাংস্কৃতিক অঙ্গনে, দেশের নেতৃত্ব দানে, পেশায় এমনকি বাঁদরামোতে কিন্তু মাত্রা ছাড়াবো না। আজ থেকে একশো বছর পরও যেন লোকে যেন গর্ব করে বলে ‘ওরা সরকারি স্কুলের ছাত্র’।

লেখক: বেসরকরি চাকুরিজীবী; প্রাক্তন ছাত্র, বাগেরহাট সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়। 
E-mail: mehdee19@gmail.com

স্বত্ব ও দায় লেখকের…
এসআইএইচ/বিআই/০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

About মেহেদী হাসান সোহেল

Exit mobile version