ইনজামামুল হক, সিডর বিধ্বস্ত শরণখোলা থেকে ফিরে । বাগেরহাট ইনফো ডটকম

২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর। উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। ঘন্টায় প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঝড়ো বাতাস লন্ডভন্ড করে দেয় দেশের ১৬টি উপকূলীয় জেলা।
২০০৭ থেকে ২০১৬। গেল ৯ বছরে বিধ্বস্ত উপকূলের বিপন্ন মানুষেরা ঘুরে দাড়িয়েছেন অনেকটাই। নিজেদের অদম্য প্রাণ শক্তিকে পূজি করে শুন্য থেকে শুরু করেছেন নতুন করে। কিন্তু সিডর আঘাত হানার নয় বছরেও প্রাণ ও সম্পদ রক্ষায় নির্মাণ হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। ফলে আজও আতংকে দিন কাটাচ্ছেন উপকূলের হাজার হাজার সাধারণ মানুষ।
সুপার সাইক্লোন সিডরের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট। কেবল জেলার শরণখোলা উপজেলায় হাজারেরও বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটে সিডরের আঘাতে। গবাদি পশু, ফসল সবকিছু হারিয় আশ্রয়হীন হন কয়েক লক্ষ মানুষ। ৯ বছর পরও সে ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকা উপকূলবাসিকে তাড়াকরে ফেলে সে রাতের বিভীষিকা।
ইউনিয়নের রায়েন্দা গ্রামের জাকির ঘরামির স্ত্রী লাইলি বেগম (৪৮)। সিডরের রাতে তিন মেয়ে, একমাত্র ছেলে ও ছেলে বউকে আশ্রয় কেন্দ্র পাঠিয়ে স্বামী-স্ত্রী ছিলেন নদী তীরে বেড়িবাঁধের পাশের ছোট্ট ঘরে। ঝড় শুরু হয়ে বলেশ্বর নদের প্রবল ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে যায় বাঁধ। গভীর রাতে বাতাস বাড়তে শুরু করলে ভেঙে পড়া গাছে আঘাতে দুমড়ে মুচড়ে যায় টিনের ছোট্ট ঘর। বৃষ্টির মাঝে বাঁধের পাশে উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেন জাকির ও তার স্ত্রী লাইলি বেগম।
প্রচন্ড ঝড়ো বাতাসের মাঝে বিশাল আকারের আকষ্মিক জলোচ্ছ্বাসের ঢেউ ভাসিয়ে নেয় দু’জনকেই। বেশ কিছুক্ষণ ভেসে থাকার পর একটি গাছের ডাল ধরে নিজেকে রক্ষা করেন লাইলি বেগম। কিন্তু সকালে আর কোন সন্ধান পাননি স্বামী জাকির ঘরামির। ছেলে মেয়েরা ফিরে আসলেও আর ফেরেনি লাইলি বেগমের স্বামী।
এই গ্রামের বাঁধের পাশের বাসিন্দা লাল মেয়া মল্লিক (৬০) বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘বাঁধ না বাইন্দে ত্রান দিয়ে কি হবে। যদি থাকনের জায়গা না থাহে তবে বাঁচপো কি বেলে? সেই সিডরের পর দে শুনছি শক্ত বাঁধ হবে। কাজও নাহি শুরু হইছে। কিন্তু কবে হবে সে বাঁধ?’
শরণখোলার রায়েন্দা ইউনিয়ন পরিষদের ৫নং ওয়াডের সাবেক মেম্বার হাবিবুর রহমান ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, উপজেলার প্রাণ কেন্দ্র রায়েন্দা বাজার। এ বাজারই উপজেলা ব্যবসা-বানিজ্যসহ অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের কেন্দ্র বিন্দু। কিন্তু সিডরের ৯ বছরেও এখানকার মানুষের প্রাণের দাবি ‘রায়েন্দা বাজারকে বেড়ি বাঁধের আওতায় আনা’র কাজ শুরু হয়নি।
তার মতে, ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধের সংস্কার কাজও সঠিক ভাবে করেনি পানি উন্নয়ন বোর্ড।
দীর্ঘ নয় বছর পর বাঁধের কাজ শুরু হলেও যে গতিতে কাজ হচ্ছে, তাতে যথা সময়ে বেড়িবাঁধের নির্মাণ কাজ শেষ করা সম্ভব নয়। এখানকার মানুষ ও জানমাল রক্ষায় দ্রুত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার পাশাপাশি কাজটি যেন মানসম্মত হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি দাবি জানান তিনি।
বাগেরহাটে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মো. নুরুল ইসলাম বলেন, সিডরের জলোচ্ছ্বাসে সে সময়ে জেলার তিনটি পোল্ডারের প্রায় ৭০ কিলোমিটার বাঁধ সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়। এরমধ্যে উপকূলীয় শরণখোলা উপজেলায় অন্তত ২৫ কিলোমিটার বাঁধ বিধ্বস্ত হয়।
বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট (সিইআইপি) প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৭শ’ কাটি টাকা ব্যয়ে বাগেরহাটের উপকূলীয় উপজেলা শরণখোলা, মোরেলগঞ্জ, রামপাল ও মংলায় ৩৫/১ এবং ৩৫/৩ পোল্ডারে আওতায় ৬৩ কিলোমিটার টেকসইবাঁধ নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে কাজ পেয়ে চায়না প্রতিষ্ঠান the first engineering bureau of Henan Water Conservancy (HWE) ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ শুরু করেছে।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বলেন, দেরিতে হলেও টেকসই বেড়িবাঁধের কাজ ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। আমরা আশাকরি বাঁধের নির্মাণ কাজ দ্রুত শেষ হবে এবং এতে করে জলোচ্ছ্বাসে জেলার উপকূলীয় এলাকার প্রাণহানির আশঙ্কা কমে আসবে।
বাঁধের কাজটি যেন মানসম্মত হয় সেজন্য জেলা প্রশাসন তদারকি করছে।
এইচ/এসআই/বিআই/১৫ নভেম্বর, ২০১৬
** উপকূলের বিভীষিকা সিডর