
৯ ডিসেম্বর, সুন্দরবনে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির এক বছর পূর্ণ হলো ! ২০১৪ সালের এই দিনে সুন্দরবনের শ্যালা নদীতে ডুবে যায় ফার্নেস তেলবাহী ট্যাঙ্কার ‘ওটি সাউদার্ন স্টার-৭’।

‘এমটি টোটাল’ নামে অপর একটি ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় ‘সাউদার্ন স্টার-৭’ ডুবির পর সাড়ে ৩ লাখ টন ফার্নেস অয়েল ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী-খালে।
তেল বিপর্যের এ ঘটনায় সারা বিশ্বে উদ্বেগের সৃষ্টি হয় সুন্দরবনকে নিয়ে। আসেন দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা। আসে সুন্দরবন সুরক্ষায় নানা সুপারিশ।
কিন্তু দুর্ঘটনার পর এক বছর পেরিয়ে গেলেও বাস্তবায়ন হয়নি অধিকাংশ সুপারিশ গুলো। ফলে ঘটছে একের পর এক দুর্ঘটনা।
জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞা ওই প্রতিনিধি দল ফিরে যাওয়ার আগে এক সংবাদ সম্মেলনে ‘সুন্দরনকে পরিবেশকে “মহামূল্যবান” এবং “বৈচিত্রপূর্ণ” উল্লেখ করে বনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধের সুপারিশ করে’। কিন্তু বছর পেরিয়ে গেলেও সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি।
ট্যাঙ্কার ডুবির পর চলতি বছরের অন্তত দু’টি বড় নৌ দুর্ঘটনা ঘটে সুন্দরবনে। ৫ মে সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর চরে তলা ফেটে ডুবে যায় সারবাহী জাহাজ এমভি জাবালে নূর। ২৭ অক্টোবর চাঁদপাই রেঞ্জের পশুর নদীর জয়মনি সংলগ্ন বিউটি মার্কেট এলাকায় ডুবে যায় কয়লাবাহী একটি কার্গো জাহাজ। ঘটনার প্রায় দেড় মাস পার হলেও এখনো উদ্ধার হয়নি এমভি জিয়ার রাজ নামের এ কার্গো জাহাজটি।
০১ ডিসেম্বর শরণখোলা রেঞ্জের মরা ভোলা নদীর চরে আটকা পড়ে ৭৪০ মেট্রিকটন সিমেন্ট তৈরির কাঁচামাল ফ্লাইঅ্যাশ বোঝাই এমভি শোভন-১ নামে একটি কার্গো। অবশ্য বড় ধরনের দুর্ঘটনার আগেই জাহাজটি উদ্ধার করা হয়।
বারবার দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের ক্ষতি সত্ত্বেও বনের ভেতর দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল বন্ধ হয়নি। এতে বনের শ্বাসমূল উদ্ভিদ, ডলফিন, অন্যান্য মাছসহ জলজ ও বজন প্রাণি হচ্ছে ধ্বংস হচ্ছে।
এদিকে, বার বার সুপারিশ করা হলেও সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধে মন্ত্রণালয় কোন কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে পরিবেশবীদ ও বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা) খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়কারী মাহফুজুর রহমান মুকুল বলেন, কোন দুর্ঘটনাকেই ছোট করে দেখার উপায় নেই। বারবার দুর্ঘটনা আমাদের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। কিন্তু আমাদের সরকার সুন্দরবন নিয়ে এখনও উদাসীন।
গত ডিসেম্বরে তেলবাহী ট্যাঙ্কার ডুবির পর সরেজমিনে সুন্দরবনে আসা গবেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজিম উদ্দীন খান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সুন্দরবন বিশ্ব সম্পদ। তাই কেবল বাংলাদেশ নয় সুন্দরবনের ক্ষতিতে সারা বিশ্ব উদ্বিগ্ন হয়। তা আমরা ট্যাঙ্কার ডুবির পর দেখেছি। সরকারসহ আমাদের সবার উচিত বিশেষজ্ঞসহ পরিবেশবিদদের মতামতের ভিত্তিতে সুন্দরবন সুরক্ষায় এক সঙ্গে কাজ করা।
বনজ সম্পদ শিকার বা পাচার যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, একইভাবে বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচলও এই বনের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ। জাহাজের বর্জ্য প্রতিনিয়ত আমাদের এই মহামূল্যবান বনের জীববৈচিত্র্যের ক্ষতিসাধন করছে।
ট্যাঙ্কার ডুবির পর বিশ্বে বিপন্ন প্রায় ইরাবতি ডলফিনের অভয়াশ্রম শ্যালা নদী দিয়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে নৌযান চলাচল বন্ধ হবে বলে ঘোষণা করে সরকার। সে সময় ৬ মাসের মাধ্যে মংলা-ঘষিয়াখালী চ্যানেল পূণ:খনন করে শ্যালা নদীর নৌরুট বন্ধ করা হবে বলা হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
বিআইডব্লিউটিএর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (ড্রেজিং) এ এইচ ফরহাদুজ্জামান বলেন, মংলা-ঘষিয়াখালী আন্তর্জাতিক নৌ-চ্যানেল খনন কাজ চলমান রয়েছে। চ্যানেলের দুই তীরের ছোট ছোট খালগুলো এখন প্রবাহমান না থাকায় প্রতিনিয়ত প্রচুর পলি জমছে। তাই খনন কাজ অব্যহত রয়েছে। বর্তমানে এ নৌপথে পূর্ণ জোয়ারে ১০-১১ ফুট গভীরতার নৌযান চলাচল করছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের শরণখোলা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, রাতে বনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল করতে না দেওয়ার নির্দেশনা পেয়েছি। আমার ইতোমধ্যে এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। সবকটি স্টেশনকে বিষয়টি জানানো হয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) সাইদুল ইসলাম বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, সুন্দরবনের সুরক্ষার জন্যই বনের ভেতর দিয়ে সবধরণের বাণিজ্যিক নৌযান চলাচল বন্ধ হওয়া উচিৎ। কিন্তু চাইলেও এ মুহূর্তে জাহাজ চলাচল পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাই দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা হিসেবে আমরা রাতে নৌযান চালাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছি।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষকেও জানানো হয়েছে। রাতে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধের পাশাপাশি দিনে বনের ভেতর যেসব নৌযান প্রবেশ করবে তার ফিটনেস ও দক্ষ চালক আছে কিনা -বিষয়টি মনিটরিংয়ের জন্য বিআইডব্লিউটিএ’র প্রতি আহ্বান জানান ডিএফও।