ইনজামামুল হক, নিউজ এডিটর । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বাগেরহাট সদর উপজেলার শেষ, পিরোজপুর-বাগেরহাট মহাসড়কের ফতেপুর বেইলি ব্রিজ। ব্রিজটি পার হয়ে বামে পিচ ঢালা আঁকাবাঁকা পথ। দু’পাশে বিস্তৃত মাঠ মাড়িয়ে সরু সে পথের গন্তব্য সবুজ গ্রমে।
গাছের পাতার ফাঁক গলিয়ে সরু পথে আলো ছায়ার খেলা চলে দিনভর। যান্ত্রিক কোলাহল মুক্ত শান্ত সবুজ গ্রামের বাতাসে এক ভিন্ন প্রশান্তি। নিমিষে ক্লান্তি মাড়িয়ে সজীব সে হাওয়া আন্দোলিত করবে যে কাউকে।
সবুজে ঘেরা সেই গ্রামে ছোট ছোট উঠোনে জোড়া এক একটি বাড়ি। উঠোন কোনে বসতঘরের পাশেই ছোট আর একটি ঘর। রান্না ঘরের মতোই কিন্তু ঠিক রান্না ঘর নয়। বেড়া বিহীন ঘরগুলোতে চুলা আছে সারি সারি। সে চুলায় রান্না হয় ঠিকই, তবে তা ভাত, মাছ বা মাংস নয়। বালুর ভেতরে রান্না হয় চাল। আর তা থেকে তৈরি হয় মুড়ি।
হ্যাঁ এতোক্ষণ মুড়িপল্লী ‘বারুইখালী’র কথাই হচ্ছিলো। বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কচুয়া সদর ইউনিয়নের গ্রামটির প্রায় শতাধিক পরিবারের পেশা মুড়ি তৈরি। ঐতিহ্যগত ভাবেই এই গ্রামের বাসিন্দারা কয়েক পুরুষ ধরে দেশিয় পদ্ধতিতে বিশুদ্ধ মুড়ি তৈরি করে আসছে।
পাশাপাশি চুলায় একদিকে চলে শুকনো বালি উত্তপ্ত করা, অন্যদিকে হালকা ভেজা চাল ভাজার কাজ। ঘর লাগোয়া উঠানে তখনও চলে ধান শুকানো। পাশের তাফালেও সমানে চলে ধান সেদ্ধ। সেদ্ধ সে ধান আবার মাটির চাড়িতে করে ভিজিয়ে রাখা হয় উঠানের পাশেই। নারকেল পাতার শলা দিয়ে নাড়া চাড়ার মাঝে ভাজা চাল হালকা হলদে-বাদামি বর্ণের হয়ে এলে উত্তপ্ত বালি ওপর দেওয়া হয় সে চাল। এবার মটির হাড়ি নাড়াচাড়া দিতেই মড় মড় শব্দে ফুঁটে উঠবে ধোঁয়া ওড়া সাদা মুড়ি।
মুড়ি তৈরির এ কৌশল গ্রামের প্রান্তিক মানুষের কাছে খুব সাধারণ। তবে ঐতিহ্যের মিশেলে গ্রামীণ পরিবেশে শৈল্পিক এই পেশা প্রতন্ত এলাকায় গ্রামীণ পর্যটন বিকাশের মাধ্যম হতে পারে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
স্থানীয় বারুইখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক শেখ নিজাম উদ্দিন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বিস্তৃত ফসলের মাঠ, সবুজ গ্রাম, নদী-খাল সবই আছে এই গ্রামে। শীতের মৌসুমে এখানকার মাঠ এবং জলাশয় গুলোতে বসে অতিথি পখির আনাগোনা। দেশিয় ভাবে মুড়ি তৈরি, এখানকার জীবন যাত্রা এবং গ্রামীণ নান্দনিক পরিবেশ সঠিক ভাবে তুলে ধরা সম্ভব হলে; এই মুড়ি তৈরিকে কেন্দ্র করেই এখানে পর্যটন বিকাশ হতে পারে। নান্দনিক এমন চিত্র ভিনদশিদের পাশাপাশি আমাদের দেশের শহুরে মানুষকেও প্রশান্তি দিবে।
কচুয়া সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিকদার হাদিউজ্জামান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বংশানুক্রমে বারুইখালী গ্রামের মানুষ এই পেশার সাথে জড়িত। কোন প্রকার রাসায়নিক বা ক্যামিকেল ছাড়াই দেশিয় পদ্ধতিতে তারা মুড়ি তৈরি করেন। স্থানীয় বাজার এমনকি জেলার বাইরে এই মুড়ির ব্যপক চাহিদা রয়েছে।
একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক সুব্রত কুমার মুখার্জী বলেন, ইউনেস্কো ঘোষিত ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট। বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐহিত্য ষাটগম্বুজ মসজিদ, হয়রত খান জাহান (রহ.) এর স্মৃতিধন্য তার মাজার, বসত ভিটা, প্রাচীন রাস্তা, সুন্দরবনসহ জেলার বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও প্রাকৃতিক সৈন্দর্য দেখতে প্রতিদিন হাজারও দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন বাগেরহাটে। তাদের কাছে গ্রামের নান্দনিক ও শৈল্পিক এমন চিত্র তুলে ধরতে পারলে এখানকার পর্যটন বিকাশের নতুন মাত্রা যুক্ত হবে।
কচুয়া উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মানষ কুমার তালুকদার বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, দেশি-বিদেশি পর্যটকরা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত, সিলেটের চা বাগান, পাড়াড়ি ঝর্ণা, পার্বত্য চট্টগ্রাম ঘুরতে গিয়ে স্থানীয় আদাবাসীদের জীবনযাত্রা, নিজেস্ব তাঁতে তাদের পোশাক তৈরির কৌশল এবং তাদের তৈরি পোশাক কিনতে যান। জীবন জীবিকাকে কেন্দ্র করেই ওই সব এলাকায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটেছে।
একই ভাবে স্ব স্ব এলাকার ঐতিহ্য, মানুষের জীবন যাত্রাকে সঠিক ভাবে তুলে ধরতে পারলে এই শিল্পের বিকাশের পাশাপাশি দেশের ঐতিহ্য রক্ষা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে সহায়তা করবে।
দ্য বেঙ্গল ট্যুরস লিমিটেডের ম্যানেজার রিয়াজুল হক বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, মুড়ি, খৈসহ দেশিয় স্ন্যাক্স জাতীয় খাদ্য তৈরি নিঃসন্দেহে টুরিজম (পর্যটনের) বিকাশের মাধ্যম। এরই মধ্যে টাঙ্গাইলে গ্রামে ভ্রমণের সময় আমরা বিদেশি পর্যটকদের কাছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্য চিড়া, মুড়ি ও খৈ তৈরি চিত্র তুলে ধরেছি। তাতে ব্যাপক সাড়াও মিলেছে। বর্তমানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য ওই অঞ্চলে ভ্রমণ প্যাকেজে আমরা দেশিয় স্ন্যাক্স তৈরির বিষয়টি অন্তভূক্ত করেছি। বাইরের দেশের পর্যটকরা বিষয়টি দারুণ ভাবে উপভোগ করেন।
বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের জেলা ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাটে ষাটগম্বুজ, মাজার, খানজাহানের প্রাচীন রাস্তাসহ বহু প্রাচীর নিদর্শন রয়েছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের অন্যতম পছন্দ এখানে ভ্রমণ। পাশাপাশি এ ধরনের হারিয়ে যাওয়া গ্রামীণ লাইফস্টাইল তুলে ধরতে পারলে তা পর্যটকদের অনেক বেশি আকৃষ্ট করবে।
দেশের পর্যটন শিল্প বিকাশের শুরুর দিকে থেকে এ খাতের সাথে সম্পৃক্ত রিয়াজুল হক মনে করেন, সুন্দরবন, ষাটগম্বুজের পাশাপাাশি এই অঞ্চলের টুরিজম বিকাশে গ্রামীণ এই জীবনযাত্রা তুলে ধরতে পারলে তা গুরুত্বপূর্ন অনুসঙ্গ হবে। এজন্য স্থানীয় অধিবাসী, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
** মুড়িপল্লী ‘বারুইখালী’
এসআইএইচ/বিআই/০৫ জুলাই, ২০১৬
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More