বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী ও সমাজসেবক অধ্যক্ষ আনোয়ার হোসেন ছিলেন একজন আদর্শ মানুষ গড়ার কারিগর। বাগেরহাটের নানা উন্নয়ন ভাবনা আর ইতিহাস সংরক্ষণে উদগ্রীব মানুষটি সবার কাজে বহুল পরিচিত ‘আনোয়র স্যার’ নামে।
শিক্ষাবিদ আনোয়ার হোসেন ১৯৪৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাগেরহাট সদর উপজেলার বাদেকাপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
বাগেরহাটের বিভিন্ন সামাজিক আন্দলনের পথিকৃত আনোয়ার হোসেনের পিতা আইন উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন শিক্ষক। তিনি দীর্ঘকাল সফলতার সাথে অনারারী ম্যাজিষ্ট্রেট-এর দায়িত্ব পালন করেন। মাতা আমেনা বেগম ছিলেন গৃহিনী।
পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে মরহুম আনোয়ার হোসেন ছিলেন সবার ছোট। প্রথম ভাই মরহুম রকিব হোসেন USIS (United States Information Service) এর চীফ লাইব্রেরীয়ান, দ্বিতীয় ভাই মরহুম মোয়াজ্জেম হোসেন একজন সরকারি চাকুরীজীবী, তৃতীয় ভাই মরহুম দেলোয়ার হোসেন খুলানা আইন মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ এবং চতুর্থ ভাই হাসিবুল হোসেন জীবন বীমা কর্পোরেশনের এরিয়া ম্যানেজার ছিলেন।
আনোয়ার হোসেনের পিতা ছিলেন ধর্মপ্রাণ, শিক্ষানুরাগী এবং মানব প্রেমী। তারই আদর্শ ও সততায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আনোয়ার হোসেন সমাজসেবায় নিজেকে উৎসর্গ করেন।
মরহুম আইন উদ্দিন আহমদ গ্রামে আগ্রহী যুব সমাজকে নিয়ে ১৯৪১ সালে বাদেকাড়াপাড়া পল্লীমঙ্গল সিমিতি গঠন করেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত আনোয়ার হোসেনের পিতা ওই সমিতির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন।
শিক্ষা জীবন:
পিতার কাছে হাতেখড়ির পর আনোয়র হোসেনের শিক্ষা জীবনের শুরু বাদেকাড়াপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। নিজ গ্রামের বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তিনি ভর্তি হন কাড়াপাড়া শরৎচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত সেখানে লেখাপড়ার পর ১৯৫৬ সালে দশানী যদুনাথ ইনস্টিটিউটে (বর্তমান-যদুনাথ স্কুল এ্যান্ড কলেজ ) ভর্তি হন।
১৯৫৯ সালে যদুনাথ ইনস্টিটিউট থেকে কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন তিনি। এর পর ভর্তি হন বাগেরহাটের ঐতিহ্যবাহী পি.সি কলেজে। ১৯৬১ সালে আই.এস.সি পাস করেন।
পি.সি কলেজ অধ্যায়নকালে ১৯৬২-৬৩ শিক্ষাবর্ষে তিনি কলেজ ছাত্র সংসদের জি.এস নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালে আনোয়ার হোসেন নেতৃত্ব দেন গনবিরোধী হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া দুর্বার আন্দোলনের। সে সময় পিএনজি (বর্তমান স্বাধীণতা উদ্যান) প্রাঙ্গণে এক জনসভায় প্রধান বক্তা হিসাবে তিনি তার সুন্দর বাচনভঙ্গি মাধ্যমে সাধারণ জনগনকে এ আন্দোলনের যথার্থত তুলে ধরতে সক্ষম হন।
১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে তৎকালীন মহাকুমা প্রশাসক সৈয়দ শাহীম আহ্সান, এমএনএ রোকামিয়াসহ অসাম্প্রদায়িক ব্যাক্তিবর্গকে নিয়ে সাধারণ মানুষের শান্তি রক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৬৯ সালে আনোয়ার হোসেন বি.এ পাশ করেন।
১৯৫২ পরবর্তি সময়ে বিরূপ পরিবেশে বাগেরহাটে শহীদ দিবস পালনে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার।
কর্মজীবন:
আনোয়ার হোসেনের কর্মজীবনের শুরু বৃহত্তর বরিশাল জেলার কাঠালিয়ার কৈখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মাধ্যমে। শিক্ষকতা শুরুর কিছুদিনের মাধ্যেই তিনি পরিচিত হন ছাত্রনন্দিত প্রিয় শিক্ষক হিসাবে। স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে ঐ অঞ্চলের সামাজিক সাংস্কৃতিক ও সেবামূলক কর্মকান্ডে জড়িত হয়ে পড়েন।
১৯৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
শিক্ষকতাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহন করা আনোয়ার হোসেন এর পরই চলে আসেন বাগেরহাটে। ওই বছর শিক্ষক হিসাবে যোগদান করেন দশানী যদুনাথ ইনস্টিটিউশনে। ’৭১-এ শিক্ষকতার নেপথ্যে মুক্তিযুদ্ধের দক্ষ সংগঠক হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন তিনি।
স্বাধীনতাত্তোর যুদ্ধবিদ্ধস্ত বাগেরহাটের সার্বিক কল্যানে নিজেকে নিয়োজিত করেন আনোয়ার হোসেন। ১৯৮১ সালে শহরের প্রাণকেন্দ্রে গড়ে তোলেন আদর্শ শিশু বিদ্যালয় (বর্তমান- আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়)।
পারিবারিক জীবন :
১৯৭৮ সালে চুয়াডাঙ্গা জেলার জীবননগর উপজেলার উথলি গ্রামের রজব আলী বিশ্বাসের মেয়ে মরিয়ম হোসেনের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আনোয়ার হোসেন। তিনি বাগেরহাট সরকারি পি.সি কলেজে অধ্যাপনা করতেন। তাদের দুই ছেলে আহমেদ হোসেন সুমন ও মাহমুদ হোসেন শোভন।
বাদেকাড়াপাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতি:
পিতার হাতে গড়া বাদেকাড়াপাড়া পল্লীমঙ্গল সমিতির আজীবন সদস্য ছিলেন আনোয়ার হোসেন। গ্রামের প্রতি পিতার ভালোবাসা ও গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য কাজ করা দেখে তিনি সামিল হন এ কাজে। গ্রামের প্রচীন সংগঠনকে টিকিয়ে রাখতে ও গতিশীল করতে বিশেষ অবদান রাখেন।
নাটাব:
জাতীয় যক্ষানিরোধ সমিতি নাটাব বাগেরহাট শাখার পুনর্গঠিত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেত তিনি। মানুষের সেবায় বস্তি এলাকায় নিরলস সেবামূলক কাজে আত্মনিয়োগ করেন।দায়িত্ব পালন করেন নাটাবের বিভাগীয় সেক্রেটারী হিসেবে। সে সময় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তাকে দেওয়া হয় জাতীয় নাটাব-্এর আজীবন সম্মাননা।
রেড ক্রিসেন্ট:
আর্তমানবতার সেবায় উদ্বুদ্ধ আনোয়ার হোসেন যুক্ত হন বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বাগেরহাট ইউনিটের সাথে। অংশ গ্রহণ করেন জেলার বিভিন্ন সেবামূলক কাজে। ১৯৭৬ সালে তিনি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বাগেরহাট ইউনিটের ন্যাশানাল ডেলিগেটের মর্যাদা প্রাপ্ত হন। আর্তমানবতার সেবায় নিবিড়ভাবে অংশ গ্রহন করে পরিচিতি লাভ করেন জাতীয় পর্যায়ে। তার সময়ে নির্মিত হয বাগেরহাট রেড ক্রিসেন্ট ভবন।
আদর্শ শিশু বিদ্যালয়:
আনোয়ার হোসেন বাগেরহাট আদর্শ শিশু বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ। বাগেরহাটে কিন্ডারগার্টেন কডেলে এটিই ছিল প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মুস্তাফিজুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় আনোয়ার স্যারের নিরন্তর প্রচেষ্টায় অল্প দিনে বাগেরহাটের একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বিদ্যালয়টি।
তার যোগ্য নেতৃত্ব ও পরিচালনায় ‘মান সম্মত ও মানবিক গুণাবলী বিকাশের’ মাধ্যম হয়ে ওঠা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি ব্যপক সুনাম অর্জন করে।
বাগেরহাট ফাউন্ডেশন:
১৯৮০ সালে বাগেরহাটের তৎকালীন মহাকুমা প্রশাসক (এস.ডি.ও) মোশারফ হুসাইন ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আ.স.ম মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে ‘বাগেরহাট ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠায় অন্যতম উদ্যোগী ও সংগঠক ব্যাক্তি ছিলেন আনোয়ার হোসেন।
চক্ষুচিকিৎসা শিবির:
আনোয়ার হোসেন বাগেরহাটে বিনামূল্যে চক্ষুচিকিৎসা শিবির কার্য্যক্রমের সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭৬ সাল থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত গরি- দু:খীদের জন্য বাগেরহাটে চক্ষুচিকিৎসা শিবিরের পরিচালনা করতেন।
এখানে শুধু চোখের অপারেশন করিয়ে তিনি নি:শ্চুপ থাকতেন না। অপারেশনের পরবর্তী ৭ দিন বিভিন্ন ব্যাক্তিদের নিয়ে সেই সকল রোগীদের সেবা করতেন। এই সেবা কার্যক্রমে তিনি যুক্ত করেছিলেন স্কুলের ছোট শিশুদের।
মানবিক মূল্যেবোধ যাগ্রত করতে শিশুদের দিয়ে অসুস্থ রোগীদের সেবা প্রদান, চিকিৎসা সহায়তার পাশাপাশী শিক্ষার্থীদের দেশ ও জাতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার জন্য বিদ্যালয়ের ক্লাস শুরুর আগে তিনি প্রতিদিন ওই দিনের উল্ল্যেখযোগ্য ঘটনা, বিখ্যাত ব্যাক্তিদের সম্পর্কে আলোচনা করতেন।
তিনি ছিলেন বাগেরহাটের চলন্ত ইতিহাস। আজীবন অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করেছেন। একই সাথে নিয়োজিত ছিলেন দুস্থদের সেবায়।
বাগেরহাটের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সমবায়, রেড ক্রিসেন্ট, বাগেরহাট ফাউন্ডেশন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়, ডায়বেটিক হাসপাতাল, অন্ধক্যাণ সমিতি, বিজ্ঞান মেলা, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বইপড়া কর্মসূচী, রোগী কল্যাণসমিতিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠান পরিচালনার সাথে সক্রিয় ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন মরহুম আনোয়ার হোসেন।
অতি সাধারন জীবনযাপন করা আনোয়ার হোসেন তার সকল উপর্জন ব্যয় করেছেন সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে। গনমুখী এই মানুষটির অসম্ভব বাগ্মীতা তাকে করেছিলো জননন্দিত।
২০১১ সালের মার্চে ভারতের পশ্চিম বঙ্গে ‘বাগেরহাট সমিতি’র পক্ষ থেকে তাকে সম্মননা জানানো হয়।
২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।
গ্রন্থনা: সুব্রত কুমার মুখার্জী
ব্লগ মডারেটর, বাগেরহাট ইনফো ডটকম।
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More