নিউজ এডিটর | বাগেরহাট ইনফো ডটকম
বিশ্ব ঐতিহ্যের শহর বাগেরহাটে পর্যটক ও দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত হচ্ছে প্রায় সাড়ে ছয়শ’ বছরের পুরনো ‘খানজাহানের প্রাচীন রাস্তা’।
সংস্কার কাজ শেষে রাস্তাটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে হস্তান্তরের পর চলতি সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাত দেশী-বিদেশী দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে।
‘ইট-নির্মিত খান জাহানের প্রাচীন রাস্তা ও সেতু’
সাউথ এশিয়া ট্যুরিজম ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভলপমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে দেশের আবিষ্কৃত অন্যতম প্রাচীন এই সড়ক ঐতিহ্যটির সংস্কার কাজ শুরু হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি সংরক্ষণের জন্য সংস্কারে অর্থায়ন করেছে এশিয়ান উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. গোলাম ফেরদৌ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, খানজাহানের নির্মিত প্রাচীন এই রাস্তাটি শতাধিক বছর ধরে মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিলো। দেশের আবিষ্কৃত একমাত্র প্রাচীন এই সড়ক ঐতিহ্যটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ননিদর্শন।
শের শাহ সুরির আমলে নির্মিত যে ‘গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড’কে এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন সড়ক হিসাবে বিবেচনা করা হয় ‘খানজাহানের প্রাচীন রাস্তা’টি এর চেয়েও শত বছর আগে নির্মিত।
সংস্কার কাজ শুরুর আগে খননের মাধ্যমে প্রাচীন রাস্তাটি উন্মোচন করা হয়। ৯৫৭ মিটার দৈর্ঘ্য ০.২৭ মিটার প্রস্থ বিশিষ্ট রাস্তার টিকে থাকা অংশটি খনন কাজে নেতৃত্বে ছিলেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ড. মো. শফিকুল আলম। তিনি বলেন, উন্মোচিত স্থাপত্য কাঠামোর মধ্যে প্রাচীন কালভার্ট, নিরাপত্তা চৌকি, প্রবেশ দ্বারসহ ১৫ শতকের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু এবং কৌতুহল উদ্দীপক প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
দেশের প্রাচীনতম সড়ক নিদর্শনটি সংস্কার কাজে ইন্টারন্যাশনাল কনজারভেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রখ্যাত কনজারভেশন আর্কিটেক্ট ড. নিলানকুরে। সংস্কার কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন শ্রীলঙ্কা থেকে আসা ৬ জন দক্ষ শ্রমিকের পাশাপাশি শতাধিক লোক।
তবে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রত্নতাত্ত্বি নিদর্শনটি রক্ষনাবেক্ষণ ও সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সক্ষমতার সথেষ্ট অভাব রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্নিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরও প্রাচীন নিদর্শনটির বিশালতা এবং জনবল সংকট রাস্তাটি রক্ষনাবেক্ষণের বড় বাঁধা হিসাবে দেখছে। একই সাঙ্গে বিরল এই প্রত্ননিদর্শনটি টিকিয়ে রাখতে অবিলম্বে স্থানীয়দের চলাচলে জন্য বিকল্প একটি রাস্তারও ব্যবস্থা করা জরুরি বলে মনে করছেন তারা।
প্রত্নতাত্ত্ব অধিদপ্ত সূত্রে জানা গেছে, ৩টি মৌজায় বিস্তৃত প্রায় এক কিলোমিটার দির্ঘ্য টিকে থাকা প্রাচীন রাস্তাটি রক্ষনাবেক্ষণে বর্তমানে একজন মাত্র শ্রমিক আছে। যেখানে প্রয়োজন ন্যূনতম ১০ জনের জনবল।
বর্তমানে সংস্কার করা ‘খানজাহানের প্রাচীন রাস্তা’টির উপর দিয়ে নব্বইয়ের দশকে এলজিআরডি পিচের রাস্তা তৈরি করে। সংস্কারের পর প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় রাস্তার দু’পাশে বসবাসকারীদের বিকল্প পথ তৈরি করে দেওয়া হয়নি। ফলে তারা প্রাচীন রাস্তাটিকে পুরাকীর্তি নয় বরং চলাচলের একটি সাধারণ রাস্তা হিসেবে গন্য করছে।
কিউরেটর মো. গোলাম ফেরদৌস বলেন, দু’পাশে বসবাসকারীদের ইতিমধ্যে রাস্তাটির যথেচ্ছ ব্যবহার ও ভারী যানবাহন চলাচল থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানিয়ে গণ চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া সরকারি গেজেট বিজ্ঞপ্তির আলোকে বিকল্প সড়ক স্থাপন, রাস্তা রক্ষনাবেক্ষণ পরিচর্যার কাজে প্রয়োজনীয় জনবল নিযুক্ত করা, রাস্তার দু’প্রান্তে টহল চৌকি বসানের পাশাপাশি পুরাকীর্তি সম্পর্কে স্থানীয় জনসচেতনা সৃষ্টিতে অধিদপ্তরের আঞ্চলিক (খুলনা) দপ্তরে প্রস্তাবনা সম্বলিত একটি আবেদন পত্র পাঠানো হয়েছে।
প্রাচীন এই রাস্তাটি সংরক্ষণের জন্য একটি বিকল্প রাস্তা তৈরি আলোচনা গড়িয়েছে জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভাতেও। বিকল্প রাস্তা নির্মাণ না হলে প্রাচীন নিদর্শনটি টিকিয়ে রাখা কষ্ট সাধ্য হবে এমন শঙ্কার বিষয়টি উঠে আসে ওই উন্নয়ণ সমন্বয় সভায়।
মো. গোলাম ফেরদৌস জানান, দেশের একমাত্র প্রাচীন সড়ক নিদর্শনটিকে ২০১১ সালে সরকার সংরক্ষণ বিজ্ঞপ্তি জারী করে এর সংরক্ষণভার প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপর ন্যস্ত করেন। প্রায় সাড়ে ছয়শ বছর পূর্বে নির্মিত দেশের কোথাও এমন টিকে থাকা প্রাচীন সড়ক নিদর্শন অস্তিত নেই।
বাগেরহাটের বিশিষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক সংগ্রাহক ও খানজাহানীয়া গণবিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যক্ষ মোঃ সইফ উদ্দিন প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে রাস্তা সুরক্ষা সম্পর্কে বলেন, পুলিশ দিয়ে পাহারাদিয়ে কোন দেশের প্রাচীন কীর্তি রক্ষা করা সম্ভব নয়। এজন্য স্থানীয় জনসচেতনা সৃষ্টির বিকল্প নেই।
ঐতিহ্য-অন্বেষণ ট্রাস্টের সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যায়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, স্থানীয়দের চলাচলের জন্য কোন বিকল্প রাস্তার ব্যস্থা না করেই প্রাচীন পথটি সংস্কারের কোন মানে হয় না। এ ভাবে কনজারভেশন (সংরক্ষণ) সম্ভব নয়। এ ধরণের গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রত্নস্থাপত্য চলাচলের জন্য ব্যবহার করতে দেওয়া ঠিক নয়।
যেহেতু রাস্তাটি স্থানীয় বসবসকারীদের চলাচলের এক মাত্র পথ, সেহেতু তাদের জন্য বিকল্প রাস্তার ব্যবস্থা না হলে ভারী যান চলাচলে মাধ্যমে গুরুত্বপর্ণ নিদর্শনটি নষ্ট হতে পারে। জনগনের চলাচলে জন্য বিকল্প বাইপাস রাস্তার ব্যবস্থা না হলে রাস্তাটি আবারও নষ্ট হয়ে যাবে।
দর্শনার্থিদের জন্য রাস্তটি উন্মুক্তের পাশাপাশি এটি সংরক্ষনে বিকল্প রাস্তা নির্মণ করতে হবে। তা না হলে প্রাচীন রাস্তাটি সংরক্ষণ করা যাবে না বলেও অভিমন এই প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞের।
এইচ/এসআই/বিআই/০৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More