• নাজিম উদ্দিন
জেলা প্রশাসন এক প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। সরকার কর্তৃক আরোপিত বিভিন্ন নীতিমালা, নির্দেশাবলী, বহুমুখী উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়নসহ বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে জনসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রশাসনের রয়েছে গৌরবোজ্জল ঐতিহ্য। কালের পরিক্রমায় পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এবং সময়ের অনিবার্য দাবীতে জেলা প্রশাসনের কর্মকান্ডের পরিধি এবং অধিক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন, পরিমার্জন এবং সংস্কার সাধিত হয়েছে।
দেশের বিকাশমান গণতন্ত্রায়নের মহা অগ্রযাত্রায় জনসেবাকে আরো অবাধ, স্বচ্ছ, গতিশীল এবং জবাবদিহি করার লক্ষ্যে সরকার কর্তৃক প্রণীত বিভিন্ন নীতিমালা বাস্তবায়নে স্বাভাবিকভাবেই জেলা প্রশাসনের কর্মকান্ডের ব্যাপ্তি ও পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। এই সার্বিক কর্মকান্ড বাস্তবায়নে জেলা প্রশাসকগণ আন্তরিকভাবে নিবেদিত রয়েছেন।
ব্রিটিশ ভারতে খাজনা আদায়ের জন্য কালেক্টরের পদ সৃজিত হয়। এই কালেক্টরকে তাঁর দায়িত্ব প্রতিপালনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনী সহায়তা ও ক্ষমতা প্রদানের জন্য তাঁকে ম্যাজিস্ট্রেসী ক্ষমতা অর্পন করা হয় এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে তাঁর একটি পদবী ও পরিচিতি অন্তর্ভুক্ত হয়।
তার পর সময়ের পরিক্রমায় অনেক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সাথে কালেক্টর এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটকে অন্তর্ভুক্ত হতে হয়েছে। ডেপুটি কমিশনার হিসেবে তাঁর আর একটি এবং সর্বশেষ পরিচিতি অন্তর্ভুক্ত হয়। সে পরিপ্রেক্ষিতে ফৌজদারী কার্যবিধি, দন্ডবিধি, পি,আর,বি প্রভৃতি বিভিন্ন আইনে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট এর ভূমিকা এবং গুরুত্ব বিশেষভাবে বিধৃত হয়েছে।
সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে জেলা প্রশাসকগণকে রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সাথে ব্যাপৃত থাকতে হয়। জেলার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতিসহ সার্বিক বিভিন্ন বিষয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, তদারকি ও জবাবদিহিতার জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ দায়িত্বপ্রাপ্ত।
সময়ের অনিবার্য দাবি এবং প্রয়োজনে মোবাইল কোর্ট আইন প্রণীত হয়। যার মাধ্যমে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ জেলার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি, শান্তি- শৃংখলা এবং স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে খুবই ইতিবাচক ভূমিকা রেখে চলেছেন এবং জনগণ কর্তৃক তা বিশেষভাবে প্রশংসিত। খাদ্যে ভেজাল প্রতিরোধ, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিভিন্ন অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূরীকরণ করে জনসেবা নিশ্চিত করণ, ইভটিজিং, বাল্যবিবাহ, যৌতুকসহ বিভিন্ন অসামাজিক, নাশকতা এবং সন্ত্রাসমূলক কর্মকান্ড প্রতিরোধে এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটগণ খুবই সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে মোবাইল কোর্ট (ভ্রাম্যমাণ আদালত) পরিচালনার ফলে এ সকল খাতের অনিয়ম, দুর্নীতি এবং নৈরাজ্য প্রতিরোধ করে একটি সুশৃংখল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। জন জীবনে শৃংখলা রক্ষাসহ জনসাধারণের জীবন-মান উন্নয়নে এ মোবাইল কোর্ট পরিচালনার বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়ে আসছে।
বাগেরহাট জেলায় ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত মোট ৪,০৯৩ টি মোবাইল কোর্ট পরিচালিত হয়েছে। এর অধীনে দায়েরকৃত মামলার সংখ্যা ৯,০৭২ টি, আসামীর সংখ্যা ৯,৩৮৪জন, অর্থদন্ডের পরিমাণ ১,৬৩,৮৪,৫২৫.০০ টাকা এবং বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড প্রদান করা হয়েছে ৮২১ জনকে।
সম্প্রতি মহামান্য সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অবৈধ ঘোষণা করে রায় প্রদান করা হয়েছে। যার ফলে বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ মোবাইল কোর্ট পরিচালনা হতে বিরত রয়েছেন। ইতোমধ্যে সারা দেশে আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির অবনতিসহ সার্বিক জীবন-যাত্রায় একটি অরাজকতার সৃষ্টি হয়েছে। এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট অবৈধ হওয়ার ফলে ওই সকল অপরাধ নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হয়ে যাবে।
কোর্টের রায় নমস্য, তবে যেহেতু বিষয়টি অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ এবং এতে মাঠ পর্যায়ে সাধারণ মানুষ ও সরকারী স্বার্থ ব্যাহত হওয়ার সমূহ আশংকা দেখা দিয়েছে। তাই মাঠ পর্যায়ের বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সামগ্রিক বিষয়টি পর্যালোচনা করার যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে বলে মনে করি। মোবাইল কোর্ট কার্যক্রম সামগ্রিকভাবে বিচারিক কার্যক্রম কি না সেটা কোর্ট বিবেচনা করবে। তবে তৃণমূল পর্যায়ে যে প্রক্রিয়ায় মোবাইল কোর্টকে প্রয়োগ করা হয় সেই প্রক্রিয়াটি যতটা না বিচারিক তারচেয়ে বেশি নির্বাহী প্রকৃতির। মূলত মোবাইল কোর্ট আইনটিও সামগ্রিক পৃথকীকরণ নীতির উপর ভিত্তি করেই প্রস্তুত করা হয়েছিলো।
‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯ এর ৭(৪) ধারা অনুযায়ী অভিযুক্ত ব্যক্তি কেবল দোষ স্বীকার করলেই তাকে দন্ড প্রদান করা যায়।’
মূলত দোষ স্বীকারের উপর ভিত্তি করেই মোবাইল কোর্ট দণ্ড আরোপ করে থাকে। ফলে বিচারিক প্রক্রিয়া সামান্যই জড়িত এর সাথে। তৃণমূল পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট প্রয়োগ হয় নির্বাহী প্রক্রিয়ায় যেটি আমি শুরুতেই উল্লেখ করেছি। নানা ধরণের লঘু অপরাধের দন্ড এর মাধ্যমে প্রদান করা হয়ে থাকে। যে অপরাধগুলোর প্রকৃতি সামাজিক ধরণের (Social Crimes)। অপরাধ লঘু হলেও এর রয়েছে বড় ধরণের সামাজিক প্রভাব। কিন্তু বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অবৈধ হওয়ায় সেই প্রভাব বাঁধাগ্রস্থ হবে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটগণ কর্তৃক মোবাইল কোর্ট পরিচালনা অবৈধ ঘোষিত হওয়ার বিরূপ প্রভাব ইতোমধ্যেই তৃণমূল পর্যায়ে পড়তে শুরু করেছে। মাঠ প্রশাসনের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, মাদক, বালু উত্তোলন বা খাস জমি দখলের একাধিক ঘটনা জানার পরেও তারা কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন নি। এমন পরিস্থিতি বিরাজ করলে মাঠ প্রশাসনের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
নাজুক অবস্থা সৃষ্টি সৃষ্টি হতে পারে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির। বাড়তে পারে বিভিন্ন অপরাধ।
তবে সে ক্ষেত্রে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অসহায়ত্ব প্রকাশ করা ছাড়া আর বিকল্প কিছুই করণীয় থাকবে না। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জেলার সার্বিক আইনশৃংখলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকলে তাঁর অবশ্যই এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আইনী ক্ষমতা থাকতে হবে। এক্ষেত্রে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার ক্ষমতা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের জন্য বিকল্পহীন।
লেখক: সহকারী কমিশনার ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, বাগেরহাট।
স্বত্ব ও দায় লেখকের…
এসআইএইচ/বিআই/১৭ মে, ২০১৭
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More