লবনাক্ততা, ছত্রাক, ফাঙ্গালের কারণে প্রতিনিয়ত ক্ষয় হচ্ছে ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদসহ বিশ্ব ঐতিহ্যের নানা স্বারক। ঝড়ঝঞ্ঝাসহ এমন বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের পাশাপাশি মনুষ্যসৃষ্ট কারণেও ঝুঁকি বাড়ছে বাগেরহাটের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর।
ষাটগম্বুজ ও সিঙ্গাইর মসজিদ লাগোয়া বরিশাল-বাগেরহাট-খুলনা আঞ্চলিক মহাসড়কটি এখন ঐতিহাসিক এই স্থাপনা দুটির বড় ঝুঁকির কারণ। নিয়মিত ভারী যানবাহন চলাচল ও এর ফলে সৃষ্ট কম্পনে বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্যতম এই দুই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের স্থায়িত্ব কমছে। তাই মহাসড়কটি প্রত্ন আইন মেনে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিতে আহ্বান জানানো হয়।
রোববার বাগেরহাট জাদুঘরের সভাকক্ষে আয়োজিত ‘বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকাভুক্ত বাগেরহাটের পুরাকীর্তির নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় স্থানীয় জনসাধারণের ভূমিকা’ শীর্ষক সেমিনারে এসব কথা উঠে আসে।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের খুলনা ও বরিশাল বিভাগীয় কার্যালয়ের আঞ্চলিক পরিচালক লাভলী ইয়াসমিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাগেরহাটের পুলিশ সুপার মো. তৌহিদুল আরিফ। অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন লেখক ও প্রত্ন গবেষক মোহা. মোশাররফ হোসেন, বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এস এম মুস্তাফিজুর রহমান, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মো. গোলাম ফেরদৌস, কাস্টোডিয়ান মো. যায়েদ প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে আলোচকরা তুলে ধরেন লবণাক্ততার কারণে ষাটগম্বুজ মসজিদের মূল মেহরাবটি এখন ভঙ্গুর হয়ে পাড়েছে। অনেক কিছুই করা হচ্ছে যা প্রত্ন আইন ও পুরাকীর্তি সংরক্ষণ আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখানে কোর জোন, বাফার জোন মানা হচ্ছেনা। যত্রতত্র স্থাপনা নির্মাণের মাধ্যমে সৌন্দর্য বিনষ্ট করা হচ্ছে। হোটেল, ফুটওভার ব্রিজসহ নানা স্থাপনা করে ঐতিহাসিক স্থাপনাকে ঢেকে ফেলা হচ্ছে। মহাসড়কে ভারী যানবাহন চলার সময় ষাটগম্বুজ মসজিদ কেপে উঠে। অবৈধভাবে খালগুলো আটকে মাছ চাষে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। যাতে স্থাপনাগুলো ডুবে যাচ্ছে।
প্রাকৃতিক কারণে এমনিতেই ঝুঁকিতে থাকা এসব ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো রক্ষায় দ্রুত ও কার্যকরি উদ্যোগ নেওয়া না হলে ভবিষ্যত প্রজন্ম আমাদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্মারক থেকে বঞ্চিত হবে।
বাগেরহাটের প্রাচিন নাম ছিল ‘খলিফাতাবাদ’। ১৯৮৫ সালে প্রাচীন এই শহরটি ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে ৩২১ নম্বর ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে ইউনেসকো। ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বা মসজিদের শহর বাগেরহাট বলতে মূলত পনেরো শতকে ইসলাম ধর্মপ্রচারক ‘খান উল আযম উলুঘ খান ই জাহানে’র হাত ধরে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে ভৈরব নদের তীরে গোড়াপত্তন হওয়া তৎকালীন নগরী বা শহরকে বোঝায়।
‘খলিফাতাবাদ’ নামের তৎকালীন শহরটি বিশ্বখ্যাত ফোর্বস সাময়িকীতে প্রকাশিত বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি ঐতিহাসিক নগরীর অন্যতম। কালের বিবর্তনে যা এখন বাগেরহাট।
এই প্রাচীন শহরের ঐতিহ্যবাহী ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ, উলুঘ খানজাহানের সমাধিসৌধ, নয় গম্বুজ মসজিদ, খানজাহানের নির্মিত প্রাচীন রাস্তা, জিন্দাপীর মসজিদ, বিবি বেগনী মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, রনবিজয়পুর মসজিদ, সাবেকডাঙ্গা পুরাকীর্তি, চিল্লাখানা প্রভৃতি। সমৃদ্ধ প্রাচীন খলিফাতাবাদ শহরের এমন অসংখ্য স্থাপনা সময়ের সঙ্গে নষ্ট হয়ে গেছে।
ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে এগুলো সংরক্ষণ ও সুরক্ষায় স্থানীয়দের সম্পৃক্ততা বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি উদ্যোগ জোরালো করার আহ্বান জানিয়ে বক্তারা বলেন, আমাদের দেশে সাইটগুলো সুরক্ষা-সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা করে কেবল প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। তবে বিশ্বের বহু দেশে সুরক্ষা কার্যক্রমের জন্য আলাদা বিভাগ রয়েছে। আমাদেরও এখন তেমন ভাবনায় আগানো জরুরি। সেই সঙ্গে পাঠ্যক্রমে ঐতিহ্যের গুরুত্ব ও সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতে হবে।
বক্তারা বলেন, কেবল পর্যটনের মাধ্যমেই বাগেরহাট জেলার আর্থসামাজিক অবস্থার আমুল পরিবর্তণ সম্ভব। এ জন্য দরকার সাঠিক পরিকল্পনা ও যথাযথ সংরক্ষণ। যার জন্য সবার আগে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং দায়িত্বশীলতার উপর গুরুত্ব দিতে হবে। সেই সঙ্গে বাগেরহাটের জন্য একটি মাস্টার প্লান তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। তা না হলে এই সব স্থাপনা একবার ধ্বংস হলে তা আর কোন ভাবেই ফিরিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়।
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More