প্রচ্ছদ / খবর / আগুন দেখতে সুন্দরবন !

আগুন দেখতে সুন্দরবন !

Fair-in-Sundorbom(4)সুন্দরবন থেকে ফিরে : নৌযানে করে দেখা, আর বনের মধ্যে পায়ে হেঁটে দেখা এক না! বেশ পার্থক্য! নৌযানে করে দেখা যায় বাইরের সৌন্দর্য আর বনে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ভিতরের অন্যরকম সৌন্দর্য।

বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁসে গড়ে ওঠা বৃহত্তর প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ ফরেস্টের নাম ‘সুন্দরবন’। প্রধান উদ্ভিদ ‘সুন্দরী’ জন্য এ বনের নাম হয়তো ‘সুন্দরবন’। এমনও কথিত আছে যে, সমুদ্রের কাছে অবস্তিত বিধায় ‘সমুন্দর’ শব্দ থেকে প্রথমে ‘সমুন্দরবন’ এবং পরে ‘সুন্দরবন’ নামের উৎপত্তি।

অপূর্ব প্রকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি হিসেবে এ বনের নাম ‘সুন্দরবন’ বললে হয়তো অযৌক্তিক হবে না। একজন নারী সব সৌন্দর্যে ভরপুর থাকায় সে ‘বিশ্ব সুন্দরী’ উপাধি পায়। আর একটি বনের যে সব সৌন্দর্য থাকা দরকার  তা পরিপূর্ন থাকায় তাকেও ‘সুন্দরবন’ বলা যায়। তবে ‘বিশ্ব সুন্দরী’র সৌন্দর্য বছরের জন্য। কিন্তু ‘সুন্দরবনে’র সৌন্দর্য বছরের পর বছর। ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদলায় সুন্দরবন।

অনেকে নারীর সুন্দর চেহারার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন ‘আগুনের মত চেহারা’। সেক্ষেত্রে অসম্ভব সুন্দর বনকে আগুনের মত ‘সুন্দরবন’ বা ‘আগুন দেখতে সুন্দরবন’ বলা যায়।

সকালে এক রকম, দুপুরে, বিকালে, সন্ধ্যায় ও রাতে সে আরেক রকম ভিন্নরুপ ধারণ করে। শুধু দিন হিসেবে নয় মাস ভেদেও তার রুপ বদলায়। সবরুপই দর্শনার্থীদের দৃষ্টি কাড়ে। তবে কারো পক্ষেই সব রূপ উপভোগ করা হয়তো অসম্ভব।

Arif-shawon-in-sundorbonযাইহোক এবার  মূল প্রসঙ্গে  আসি। বেশ কিছুদিন আগে যখন সুন্দরবনে গিয়েছিলাম তখন এক সহকর্মীর স্ত্রী তার কাছে ফোন করে জানতে চেয়েছিল ‘সুন্দরবনে কি মটর সাইকেলে গিয়েছো’? কথাটা নিয়ে সহকর্মী আমার সাথে হাসি ঠাট্টা করলেও এবার মটর সাইকেলে সুন্দরবনে যাবার পর আর হাসি ঠাট্টা আসলো না। বাস্তবেই মটর সাইকেলে সুন্দরবন যাওয়া যায়। তবে বর্ষাকাল বাদে।

মোড়েলগঞ্জ উপজেলার চাঁদপাই রেঞ্জের গুলিশাখালি টহল ফাঁড়িতে মটর সাইকেল রাখা হল। সেখানে মংলার বেশ কয়েকজন প্রথিতযশা সাংবাদিকের সাথে দেখা হল। তখন সকাল সাড়ে ৬ টা, ২২ মে-২০১৪। সকলেই আগুন দেখতে সুন্দরবন যাব।

এবার বনে আগুন দেখতে যাবার পালা। মনের ভিতর এক অজানা ভয়। অভয় দিল এক শিশু। বলল-বাইশেরছিলা যাবেন? আমার সাথে আসেন। তাকে অনুসরণ করে প্রায় কিলো খানেক হাঁটা হল। কিন্তু তা উল্টো পথে। এবার তার কথায় কান না দিয়ে বন কর্মকর্তাদের ফোন করে ঠিকানা জানলাম।Fair-in-Sundorbom(1)

জিউধারা ফরেস স্টেশন কর্মকর্তা সুলতান মাহমুদ একটি বাকল খোলা গাছের কথা বললেন। ওই গাছই ওই এলাকায় প্রবেশের চিহ্ন। সেখান থেকে ছোট গলি বেয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। খুঁজতে খুঁজতে পিছনে এসে বাকল খোলা গাছ পেয়ে গলির ভিতরে ঢুকলাম। বিশাল একটি ফাঁকা মাঠ। মাঠে ফুটেছে কাথাজুড়ি শাকের ফুল। মাঠের পশ্চিম পাশ দিয়ে শিশু সহ বেশ কয়েকজন কলস নিয়ে বনের দিকে ‘কু-উ-ক’(সংকেত) দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। সবাই হৈ চৈ করে উঠলাম ওদের সাথে গন্তব্যে যেতে পারবো।

ওরা আমাদের না নেয়ার জন্য দৌড়ে বনের ভিতর ঢুকে গেল। পিছু পিছু আমাদের এক সহকর্মীও দৌড় দিল। কিছু দূর যেয়ে তাদের না পেয়ে থেমে গেল।

সেখানে অনেক গুলো গলি। কোন দিকে যাব । ভয়ও লাগল, দুঃচিন্তাও হল। মানুষের পায়ের ছাপ দেখে একটি গলি বেয়ে এগাতে গুরু করলাম। উঁচু নিচু পথ। ঘন গাছ পালা। ১০ হাত সামনেও কিছু দেখা যায় না। গা শিউরে উঠে। বাঘের পেটে যাবার ভয়টা বেশি। সাপের কামড়ের ভয় তো আছেই। যেন এক অন্য রকম রোমান্স!

পায়ে কিসের যেন খোঁচা লাগল। চামড়া উঠে গেল । বেশ কিছুদূর হাঁটার পর অস্বাভাবিক গরম লাগল। কোন কিছু মালুম না করে ছোট ছোট পাখি আর নানা ধরনের অচেনা গাছ, লতাপাতা, ফুল দেখতে দেখতে এগোতে লাগলাম। এর মধ্যে ‘যশোরে’র লতা আর ‘বলা’ গাছই বেশ পরিচিত। ‘বলা’র ফলের আঠার সাহায্যে কাগজ লাগিয়ে শৈশবে ঘুড়ি বানাতাম আর দুরন্তপনায় শরীরের কোথাও কেটে গেলে ‘যশোরে’র পাতা দিতাম রক্ত পড়া বন্ধের জন্য। যত এগোচ্ছিলাম ভয় ততই বাড়ছিল।

Fair-in-Sundorbom(3)বহুদূর যাবার পর পোড়া গন্ধ পেলাম। আরো কিছুদূর এগোনোর পর ফায়ার সার্ভিসের মেশিনের শব্দ পেয়ে এগিয়ে গেলাম।

অনেক লোক। তারা বলা গাছ কেটে ফায়ার সার্ভিসের পাইপ নেয়ার পথ তৈরি করছেন। তাদের সাহায্যে আগুন দেখতে পেলাম। বিভিন্ন জায়গায় অল্প অল্প জ্বলছে। যেখানে জ্বলছে সেখানে পানি দেয়া হচ্ছে। এক জায়গায় নিভানো হচ্ছে আরেক জায়গায় জ্বলে উঠছে। এই প্রথম দেখলাম ‘অদৃশ্য আগুনে পোড়া সুন্দরবন’। যেমন পোড়ে মন…। মাটি দিয়ে এগিয়ে যায় আগুন। গাছের উপরে উঠলে দেখা যায় শুধু ধোয়া।

মোড়েরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা আরিফুল হক জানান, আগুন মাটির নিচ দিয়ে গাছের পাতা ও শিকড় বেয়ে অদৃশ্য ভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিভাতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

fair-in-sundorbon-5বনজীবীরা ২১ মে সকালে আগুন জ্বলতে দেখে বন বিভাগে খবর দেয়। ওই দিন সন্ধ্যায় বন বিভাগ ফায়ার সার্ভিসের লোকজন নিয়ে সেখানে গেলেও ভাটার কারণে কিছুই করতে না পেরে ফিরে আসে। কারণ রাতে বনের গহীনে দুর্গম এলাকায় থাকা অসম্ভব। পরদিন সকালে তারা আবার যায়।

আধাঘন্টা পর সেখান থেকে ফিরে এলাম। এরই মধ্যে পথ হারিয়ে ফেললাম। এক বনজীবীর সহযেগিতা নিতে হল। ফেরার পথে আর পা এগাচ্ছে না। কিছুই পেটে পড়ে নি। আমার এক সহকর্মী গুলিশাখালি টহল ফাড়ির আমগাছ থেকে একটি পাকা আম পেড়ে ব্যাগে রেখে ছিলেন। ফেরার পথে বনের ভিতর দাঁড়িয়ে দু’জনে ভাগ করে আমটি খেলাম। এরপর সংবাদ পাঠিয়ে বিকাল ৫ টার দিকে ভাত খেলাম। এ পর্যন্ত পানি ছাড়া আর কিছুই পেটে পড়ে নি। অসম্ভব কষ্ট করলাম সেদিন। নিউজ করতে গিয়ে এতো কষ্ট হলে, নিভাতে যারা গেল তাদের না জানি কত কষ্ট হয়েছে।

তবে শুনেছি মোড়েরগঞ্জ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা আরিফুল হক সহ বন বিভাগের আরো কয়েকজন অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। ২১ মে লাগা অদৃশ্য আগুন নিভলো ২৩ মে সন্ধ্যা। এরই মধ্যে পুড়ে গেল কয়েক একর বন।

২৬ মে ২০১৪ :: আরিফ সাওন, হেড অব নিউজ,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।

About Arif Shaon