প্রচ্ছদ / খবর / নোনা-তাপে মরছে মাছ, চাষির নাবিশ্বাস

নোনা-তাপে মরছে মাছ, চাষির নাবিশ্বাস

Bagerhat-Salinity-Heat-Fish-Death-pic-(08-06-2015)প্রচন্ড তাবদাহ আর লবণাক্ততার প্রভাবে বাগেরহাটের মৎস ঘের গুলোতে মড়ক দেখা দিয়েছে। মরে যাচ্ছে সাদাসোনা খ্যাত বাগদা চিংড়ি ও সাদা মাছ। তাপ ও লবণাক্ততার প্রভাবে সব হারানোর শঙ্কায় বাড়ছে নাভিশ্বাস।

প্রতিদিনই মরছে ঘেরে মাছ। আর চাষিরা তা ঘের থেকে তুলে ফেলছে। আবার কোন কোন ঘের মালিক মরে যাওয়া মাছ তুলতে তুলতে অপারগ হয়ে, বাদ দিয়েছেন ভেসে থাকা মরা মাছ তোলা। গত প্রায় দেড় মাস ধরে চলছে এমন অবস্থা।

সোমবার (৮ জুন) সরেজমিনে বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াপাড়া, ষাটগম্বুজ ও ডেমা ইউনিয়নের বিভিন্ন মৎস ঘের ও বিল অঞ্চলে ঘুরে দেখা গেছে এ চিত্র।

গ্রীষ্মের প্রচন্ড খরতাপে শুধু এ অঞ্চলই নয়, পুড়ছে গোটা জেলা। আর উত্তাপের এমন চিত্র প্রায় পুরো দক্ষিণ-পশ্চিমের জনপদ জুড়ে।

ঘের ও বিল অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বৃষ্টি না হওয়া এবং রোদের প্রখর তাপে জলাসয় গুলোতে পানির পরিমানও কমে গেছে। সেইসঙ্গে অতিরিক্ত গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠেছে সাধারণ মানুষের।

স্থানীয় মৎস চাষিরা জানান, বিগত বছর গুলোর চেয়ে চলতি গ্রীষ্মে তাপমাত্রা অনেক বেশি। দেখা নেই বৃষ্টিরও। ফলে নদ-নদী দিয়ে আশা পানিতে বেড়েছে লবণাক্ততা।

Bagerhat-Salinity-Heat-Fish-Death-pic-2(08-06-2015)চিংড়ি চাষের জন্য এ অঞ্চলের ঘের গুলোতে ঢুকানো হয় নদ-নদীর নোনা পানি। কিন্তু বৃষ্টি না হওয়াতে এবং প্রচন্ড উত্তাপে ঘেরের পানি শুকিয়ে (বাষ্প) পানিতে লবণাক্ততা বেড়ে গেছে বহু গুন। অত্যাধিক তাপে সে পানি উত্তপ্ত হচ্ছে দ্রুত।

ফলে দেখা দিয়েছে মাছের মড়ক। গত প্রায় দেড় মাস ধরে চলছে এমন অবস্থা।

মৎস বিভাগের তথ্য মতে, বাগেরহাট জেলায় মোট ঘেরের সংখ্যা ৭১ হাজারেরও বেশি। এসব ঘের এবং অধিকাংশ পুকুরে রুই, কাতল, পাঙ্গাসসহ সকল প্রকার সাদা মাছ ও চিংড়ি মরে যাচ্ছে বলে চাষিরা জানিয়েছেন।

রোদের (সূর্যের আলোর) অতিরুক্ত উত্তাপে ঘেরে পানি শুকিয়ে এবং পানির তাপমাত্রা বেড়ে অনেক ঘেরে মাছ মরে যাচ্ছে বলে স্বীকার করেছে মৎস বিভাগও।

সদর উপজেলার কাড়াপাড়া-মিরজাপুর মৎসজীবি সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদাক মো. আলমগীর হোসেন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, প্রচন্ড গরম, তাপ আর পানিতে লবণাক্ততার কারণে তার ৫টি ঘেরের সব গুলোতেই সাদা মাছসহ গলদা চিংড়ি মরে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে তাদের ১০০ একর জমিতে কাটা ঘেরে প্রায় ২০ লক্ষ টাকার মাছ মরে গেছে।

অত্যাধিক গরম এবং বৃষ্টি না হওয়াতে পানিতে লবণাক্তা বেড়ে গিয়ে এ অঞ্চলের সব মৎস ঘেরের চিত্রই এমন বলে জানান তিনি।

ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের দাসের হুলা, সাতফুলি মৌজায় তার একটি মৎস ঘেরের দাড়িয়ে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, সব ধরণের মাছ চাষের জন্য (মিশ্র চাষ) সাধারণ ভাবে ঘেরের পানিতে ৬, ৭, ৮ মাত্রার পিপিটি (লবণাক্ততা) থাকা ভালো। কিন্তু বর্তমানে তা বেড়ে ১৮-১৯ পিপিটি এর কাছাকছি। যেখানে পিএস কোন অবস্তাতেই ১০-১২ এর উপরে যাওয়া উচিৎ নয় তাও এখন ১৬ এর উপরে।

Ghare-Fish-Cultivation-Pond-Picএ কারণে মে মাস থেকে এই এলাকার ঘের গুলোতে মাছ মরতে শুরু করেছে। প্রায় সব ঘেরেই মরছে মাছ।

তবে তাদের এই দুর্দশার খররে এখনও মৎস বিভাগের কোন কর্মকর্তা কিম্বা মাঠ কর্মীকে পাসে না পাওয়ার অভিযোগ তার।

আলমগীর হোসেনর ঘেরের কর্মচারি নিপন কুমার সাহা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘গত ১৪ বছর ধরে এই ঘেরে কাজ করি। এর মধ্যে এরম সমেস্যা আমি কোন দিনও দেখিনি। গত বিশ (২০) দিনের মধ্যে কোন বৃষ্টি নেই।’

সব ঘেরে মাছ মরে যাচ্ছে। অনেক ঘেরের মালিক তাই কর্মচারিও ছেড়ে দিচ্ছেন।

তার এ কথার প্রমান মিলে বাসার আমিন কর্মকারের (২৭) সাথে কথা বলে। শশীখালি বিলে দাসেরহুলা মৌজায় অসিম সিকদারের মৎস ঘেরে কাজ করতেরন তিনি।

সব মাছ মরতে শুরু করায়, লোকসান পুসিয়ে উঠতে না পারার শঙ্কায় তিন দিন আগে বাসারকে ঘেরের কাজা থেকে বাদ দিয়েছেন ঘের মালিক অসিম সিকদার।

বাগেরহাট সদরের কাড়াপাড়া ইউনিয়নের পশ্চিম পাড়া গ্রামের মৎস চাষি শেখ আবুল হোসেন (৪৭)বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, বিশ লবণে সব মাছ মরে যাচ্ছে। আগেও এই এলাকায় লবন ছিলো কিন্তু এবার পানিতে লবণের পরিমান অনেক বেশি। তাই সব মাছ মরে ভেসে উঠছে।

৩০ বছর ধেরে মাছ চাষের সাথে সম্পৃক্ত এই চাষি জানান, কখনও পানিতে এতো লবন দেখিনি। এমন অবস্থা চলতে থাকলে শুধু মাছ নয় সব মরে যাবে। এখনই ডেমা ঘের এলাকা গুলোতে কোন গাছ নেই। এর পর কয়রা, দাপপের (ঘুর্ণিঝড় আইলার পর লবণাক্ততায় বিপর্যস্থ এলাকা) মত অবস্থা হবে।

Bagerhat-Salinity-(08-06-2015)বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষী সমিতির আহ্বায়ক ফকির মহিদুল ইসলাম সুমন বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে  জানান, গরম আর লবণে সব মাছ মরে ভেসে উঠছে। জেলার অধিকাংশ ঘের গুলোর চিত্রই এমন।

অনেক স্থানে বিশেষ করে বাস-বাড়ির পুকুরে পানি ঠান্ডা রাখতে নারকেল-সুপারির পাতা দিয়ে মাঁচা তৈরি করা হচ্ছে। তবে তাতেও তাপ থেকে মাছকে বাঁচানো যাচ্ছে না।

তিনি আরো বলেন, গত মৌসুমে হরতাল-অবরোধ আর আন্তর্জাতিক বাজারের কারনে ভাল নেই ‘সাদা সোনা’ চাষীরা। আর এবার শুরুতেই এমন ধাক্কায় এই শিল্প বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা তার।

জানতে চাইলে বাগেরহাট মৎস্য বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা (ডিএফও) নারায়ন চন্দ্র মন্ডলও স্বীকার করেছে তাপের কারণে বিভিন্ন স্থানে মাছ মারে যাওয়ার বিষয়টি।

বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, তাপ মানে তো পরিবেশ বিপর্যয়। যে পরিমানের রোদ্র, ঘেরে পানি কম কিছু মাছ তো মারা যাবেই। দেখা যাচ্ছে ৪ ইঞ্চি, ৮ ইঞ্চি পানি আছে। এর মধ্যে তো মাছ বাঁচিয়ে রাখা কঠিন।

বৃষ্টি হচ্ছে না। অত্যাধিক রোদে পরিবেশ বিপর্যায়ের কারনে এমন অবস্থা বলে মন্তব্য তার।

তবে লবণাক্ততার কারণে মাছ মরছে না বলে দাবি এই মৎস কর্মকর্তার। যদিও সরেজমিনে মাছ মতে থাকা বিভিন্ন ঘের পাড়ের মাটিতে লবনের কারনে সাদা আবরণ পড়তে দেখা গেছে।

তীব্র তাপদহে ভুক্তভোগী, চার্ষী ও মৎস বিভাগ সবাই বলছে, এখন বৃষ্টি ছাড়া এই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার কোন বিকল্প নেই।

০৯ জুন ২০১৫ :: ইনজামামুল হক, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
এজি/এসআইএইচ/এনআরএ/বিআই
** ভাল নেই ‘সাদাসোনা’ চাষীরা

About Inzamamul Haque