
- মৌমাছির কামড় বিনে মধু সংগ্রহ সম্ভব নয়। এতে রেহাই পান না মৌয়ালরাও। তাদের জয় করতে হয় ডাকাত, বাঘ ও বিষাক্ত সাপের আক্রমণ। মিষ্টি মধুতে মিশে থাকে জীবনের ঝুঁকি, ভয় আর উত্তেজনাকর নানা কাহিনী। ছবি— সেখ মহির উদ্দিন।
বিশ্বের অন্যতম বড় এবং ভয়াল মৌমাছির মধু সংগ্রহের অভিযান থেকে তো আর সহজে পার পাওয়ার উপায় থাকে না মৌয়ালদের (মধু সংগ্রাহক)। ভয়ঙ্কর সব প্রাণীর আক্রমণ ছাড়াও তাদের মোকাবেলা করতে হয় মৌমাছিকে। থাকতে হয় অস্ত্র দক্ষতা, অভিজ্ঞতা, সুতার গামছা, আগুন আর বনবিবির দয়া।
বাংলাদেশের সুন্দরবন অঞ্চলের মধু সংগ্রহের কারবার দেখতে প্রতি বছর অনেক বিদেশী পর্যটকই এসেন এখানে। মিশে যান মৌয়ালদের সঙ্গে। মাছ ধরার নৌকায় করে সুন্দরবনের সরু খাল আর জলপথ ধরে সেই ভীতিকর অভিযানে অংশ নিয়েছেন তারাও। আর মধু কিনে নিয়ে গিয়ে যান নিজের দেশে। এমন একটি অভিজানের অংশ হয়ে ছিলেন বিবিসির সাংবাদিক আনবারাসান ইথিরাজান।
তিনি লিখেছেন, এ অভিযানের পদে পদে থাকে ঝুঁকি। এসব মোকাবেলায় মৌয়ালদের অবলম্বন ‘বনবিবি’। তার বর্ণনায় সব সম্প্রদায়ের মৌয়ালরা মধু সংগ্রহের আয়োজন শুরু করেন বনবিবিকে তর্পণ করার মধ্য দিয়ে। তারপর শুরু হয় পাতা, ডাল ইত্যাদি সংগ্রহের কাজ। মধুর (মৌমাছির) চাক কোথায় আছে, তা বোঝার জন্য বায়ুর দিক, মৌমাছির ওড়াওড়ি এবং গাছের পাতায় তাদের পুরীষ কী পরিমাণে জমেছে, তা খেয়াল করা হয়। যেখানে পুরুষ মৌমাছির পরিমাণ বেশি, বুঝতে হবে তার আশপাশেই কোথাও আছে মধুভাণ্ড।
এরপর জঙ্গলে নেমে খোঁজা হয় কোন গাছে জমেছে সেই চাক। কোনো গাছের মগডালে হয়তো হাজারো মৌমাছি ঘিরে রেখেছে কোনো চাক। এত সহজে তাদের কাছে যাওয়া যায় না। প্রথমে মুখ ও শরীরের খালি অংশ সুতার গামছা দিয়ে পেঁচিয়ে নিতে হয়। এরপর লাঠির আগায় বাঁধা গাছের পাতায় আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। তাতে ধোঁয়া ওঠে।
সেই ধোঁয়ায় মৌমাছিরা সরে যেতে থাকে। অন্য কোনো মৌয়াল তখন চাক কাটতে শুরু করেন। ইথিরাজান খেয়াল করেছেন সবার মধ্যেই একটা তাড়া কাজ করে তখন। একজন মৌয়াল সে সময় ষাঁড়ের শিঙায় ফু দিতে থাকেন। এতে বাঘ খেদানো (তাড়ান) সহজ হয়। এর মধ্যেই চাক কাটা শেষ হয়ে যায়। বাঁশের ঝুড়িতে এগুলো সংগ্রহ করা হয়।
এমনি এক অভিযানে এসেছিলেন “জেসিকা কার্টার”। মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে বাঘের আক্রমণে মারা যাওয়া অনেকের কথাই তিনি শুনেছেন সেই সময়ে। সংগৃহীত মধু চেখে দেখেছেন, নিজের দেশে তা নিয়েও গিয়েছেন।
জেনে নিয়েছেন এপ্রিলে শুরু হওয়া মধু সংগ্রহের অভিযান চলে তিন মাস। বাকি সময়ে মৌয়ালরা মাছ ধরে জীবন চালায়। “এরলিন্ডা কার্তিকা” নামের এক ইন্দোনেশিয়ান নারীও এসেছিলেন সে সময় সুন্দরবনে।
নিজের ব্লগে তিনি লিখেছেন, প্রায় প্রত্যেক মৌয়াল মধু সংগ্রহের সময় বাঘের সঙ্গে মোলাকাত করেছেন।

পেগ হেরিংয়েরও রয়েছে এমন অভিজ্ঞতা। তিনিও সেই বাঘের কথা উল্লেখ করেছেন। তার হিসাবে একটি বড় মৌমাছির চাকে অন্তত ১০০ পাউন্ড মধু জমা হয়। আর এমন একটি চাক ঘিরে থাকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার মৌমাছি। এদের একেকটি লম্বায় প্রায় আধা ইঞ্চি। তার মতে, মধু সংগ্রহ সবার কাজ নয়, অল্প কয়েকজনের পক্ষেই কাজটা সম্ভব।
মৌয়ালদের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সুন্দরবনের ভেতরে এসব রোমাঞ্চকর মধু সংগ্রহের দৃশ্য দেখার ব্যবস্থা করছে বেসরকারি অনেক ভ্রমণ সংস্থা। মৌয়ালদের মধু সংগ্রহ দেখতে চাইলে যোগাযোগ করতে পারেন অভিজ্ঞ ভ্রমণ সংস্থার সঙ্গে। সুন্দরবনে মধু সংগ্রহের জন্য সাধারণত মৌয়ালরা প্রতিবারে ১৫ দিনের অনুমতি পান।
এ বনের সবচেয়ে ভালো মানের মধু হলো খোলসী ফুলের ‘পদ্ম মধু’। মানের দিক থেকে এরপরেই গরান ও গর্জন ফুলের ‘বালিহার মধু’। মৌসুমের একেবারে শেষে আসা কেওড়া ও গেওয়া ফুলের মধু অপেক্ষাকৃত কম সুস্বাদু।
খাঁটি মধু চেনার সহজ উপায়- এক টুকরা কাপড় কিংবা কাগজ মধুতে ডুবিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেখা। মধু ভেজানো কাপড় বা কাগজ টুকরো ভালোভাবে জ্বললে মধু খাঁটি, না জ্বললে ভেজাল। – বণিক বার্তা।
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More