১৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমার সেলফোনটি বেজে উঠল। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে প্রেরক বললেন আমি অরুন বলছি— আপনার চিত্ত স্যারের ছোট ভাই। উনি খুবই অসুস্থ। তিন/চার দিন আগে খাট থেকে পড়ে গিয়ে পায়ের হাঁটুর কাছাকাছি জায়গায় ভীষণ চোট লেগেছে, সম্ভবত হাড় ভেঙে গেছে। তাকে খুলনায় ২৫০ বেড হাসপাতালের কাছে একটি ক্লিনিকে ভর্তি করেছি। দাদা প্রায় অচেতন বা অর্ধচেতন থাকেন। যখন একটু চেতন ফিরে আসে তখন তার কেমন লাগছে বা কি খেতে ইচ্ছা করছে জিজ্ঞেস করলে খুবই কম কথায় জবাব দেয়। মাঝে-মধ্যেই জিজ্ঞেস করেন, আমার সালাম কই? সালাম কেমন আছে?
আমি চিত্ত স্যারের মাধ্যমিক লেভেলের ছাত্র। বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলায় ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় গিলাতলা হাইস্কুল। প্রতিষ্ঠানটি দেশের দক্ষিণাঞ্চলে বহুকাল ধরেই অন্যতম সেরা স্কুল হিসেবে পরিচিত। উদ্যোগী প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম বাবু কুবের চন্দ্র বিশ্বাস ছিলেন স্কুলটির প্রথম প্রধান শিক্ষক। আমি ’৬৯ সালে যখন এই স্কুলে ৯ম শ্রেণির ছাত্র তখন তিনি আমাদের কয়েক মাস পড়িয়ে অবসরে যান। শুরু থেকেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থেকে বঙ্গবন্ধুর খুবই সান্নিধ্যভাজন ছিলেন তিনি।
১৯৭০ সালে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এবং বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র রচয়িতাদের একজন ছিলেন তিনি।
আমার হাতেখড়ি হয়েছিল আমার গ্রামের পাঠশালায় শ্রদ্ধেয় নিশিকান্ত মাস্টার মহাশয়ের হাতে। মাস্টার মহাশয় আমাদের পড়ানোর চেয়ে আদর করতেন বেশি। প্রায় প্রতিদিনই নিজ বাড়ির কলা, জাম্বুরা, আমের সময় আম-কাঁঠাল আমাদের জন্য সঙ্গে নিয়ে আসতেন এবং আগে ঠিকমতো পড়া শেষ করলে একটি বেশি দেবেন এই লোভ দেখিয়ে পড়া আদায় করে নিতেন। মাস্টার মহাশয়ের কাছেই আমরা স্বরবর্ণ-ব্যঞ্জনবর্ণ, ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত লেখা, দু-পাঁচটি ছোট যোগ-বিয়োগ, ধারাপাত, আদর্শলিপি এসব পাঠ শিখেছি। মাস্টার মহাশয় গেল শতকের ’৯০-এর দশকে মারা গেছেন। আমার প্রাথমিক শিক্ষা লাভও আমার গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রধান শিক্ষক ছিলেন হাশেম স্যার কোমলে-কঠিনে মেশানো এক আদর্শ শিক্ষক। আমাদের বৃত্তি পরীক্ষার সময় সে যে কি যত্ন নিয়ে স্যার আমাদের পড়াতেন। স্যার প্রায় একশ বছর ছুঁই ছুঁই করে ২০১৪ সালে পরপারে চলে গেছেন। শেষ বয়সে স্যার দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। আমি এ সময় (স্যারের বয়স তখন ৯৪/৯৫ বছর) এক দিন স্যারকে তার বাড়িতে দেখতে গিয়েছিলাম। তার শরীর এবং অন্ধত্বের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করতেই স্যার বললেন সেঞ্চুরি না করে যাচ্ছি না, চিন্তা করিস না। অন্ধত্বের ব্যাপারে বলতে গেলে আমার গা-মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন আমি তোকে, জিল্লুুরকে, জলিলকে, ইউনুসকে ইলিয়াসকে তো আগের মতোই দেখতে পাই— আমি অন্ধ কে বলেছে?
তার ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে বললেন, তোরা যদি সমাজে আলো ছড়াস সে আলো আমার চোখে না হলেও মনে ধরা দেয়; তোদের উজ্জ্বলতার মাঝ দিয়েই আমি পৃথিবীটাকে দেখতে পাই, আমার জন্য তুই দোয়া করিস।
তিনি যে নামগুলো উচ্চারণ করেছিলেন আমি ছাড়া অন্যরা এখন প্রয়াত। তিনি তাদের নামগুলো উচ্চারণ করে কাঁদতে লাগলেন আর আমাকে বার বার জড়িয়ে ধরতে লাগলেন। আমিও তখন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি; বাকরুদ্ধ হয়ে স্যারের বুকে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। স্যার আমাকে আদর করতে করতে নিজেকে সামলে নিয়ে আমার জন্য খাবার আনতে বললেন। আমি সেই অনুভূতি যে কীভাবে প্রকাশ করব তা বুঝে উঠতে পারছি না। আমার সেই হাশেম স্যারও আজ নেই। স্রষ্টা তাকে বেহেশত নসীব করুন।
আমি জুনিয়র হাইস্কুল পর্যায়ে পাঠ নিয়েছিলাম রামপাল উপজেলার শ্রীফলতলা হাইস্কুলে। স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন নূরুল হক স্যার ও তার বাবা জহুর ডাক্তার সাহেব। নূরো স্যার ছিলেন আমাদের প্রধান শিক্ষক। স্যার তখন সবে বিয়ে করেছেন। আমরা শুনেছিলাম স্যার নতুন বউয়ের গয়না পর্যন্ত বিক্রি করে দিয়েছিলেন স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে। স্যার অবসরে গিয়ে প্রায়শ তার ছাত্রদের খোঁজখবর নিতেন। আমার এলাকার যার সঙ্গেই দেখা হতো তাকে জিজ্ঞেস করতেন— ‘আমার সালাম কেমন আছে’? স্যারও দুই/তিন বছর হলো পরপারে চলে গেছেন। ছাত্রদের প্রতি এবং তার প্রতিষ্ঠানের প্রতি স্যারের যে কি আদর কি মায়া এমন আদর আর মায়া কখনো আর কারও কাছ থেকে পাব বলে মনে হয় না। স্যারের ধ্যান, জ্ঞান, স্বপ্ন সবকিছুই ছিল তার প্রতিষ্ঠান এবং ছাত্রদের নিয়ে। হয়তো একটু ভালো ছাত্র হওয়ার কারণে তার একটু বেশি মায়া, বেশি স্বপ্ন ছিল আমাদের ঘিরে। এ স্বপ্নাতুর মহাপ্রাণ শিক্ষকের স্বপ্ন পূরণ করা আমাদের পক্ষে আদৌ সম্ভব নয়। এ ক্ষণে শুধু তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
১৮ মার্চ সকালে মনিং ওয়ার্ক শেষ করে বাসায় ফিরে মোবাইল খুলে দেখি আমার চিত্ত স্যারের ছোট ভাই অরুনের চারটি মিসড কল। মনটা তখনই যেন ভেঙেচুরে উঠলো। ফোন ব্যাক করতেই অরুন জানালো— দাদা, সব শেষ হয়ে গেছে, আপনার স্যার নেই, শেষ রাতের দিকে চলে গেছে। আমার চিত্ত স্যার খাট থেকে পড়ে গেলে তার পরিবারের সদস্যরা তাকে গত মাসের শেষ দিকে ঢাকায় এনে ভর্তি করিয়েছিলেন বাংলাদেশ স্পাইন অ্যান্ড অর্থোপেডিক হাসপাতালে। আমি চার/পাঁচ দিন তাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। প্রথম দিন স্যার তন্দ্রাভাবে ঘুমিয়েছিলেন। স্যারের মেয়ে যখন স্যারকে বলল আমি এসেছি তত্ক্ষণাৎ তিনি চোখ খুলে এবং ইশারা দিয়ে আস্তে করে বললেন আব্বা, আমার কাছে এসো। আমি কাছে বসে স্যারের মাথায় হাত রাখলাম। স্যার বললেন, সময় বোধ হয় আর বেশি নেই। স্যারের সঙ্গে আলাপ শেষ করলে তার মেয়ে জানাল কয়েক দিনের মধ্যে এ সময়টুকু বাবাকে যেন খানিকটা ভালো দেখলাম, আপনি একটু মাঝে-মধ্যে আসবেন।
স্যার ১০/১৫ দিন হাসপাতালে ছিলেন। আমি তাকে রক্তের ব্যবস্থা করে পায়ের অপারেশন করালাম। তিনি একটু ভালো হয়ে খুলনায় গিয়ে আড়াইশ বেডে (খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল) ভর্তি থাকলেন। আমি সব সময় টেলিফোনে যোগাযোগ রাখতাম। স্যারের ডায়াবেটিস এবং প্রেসার অনিয়ন্ত্রিত ছিল। কিন্তু দুদিন আগে জেনেছিলাম সেগুলোও নিয়ন্ত্রণে তবে শারীরিকভাবে তিনি খুবই কাহিল। ভেবেছিলাম স্যারের বয়সের (৭৭ বছর প্রায়) কারণে এ অবস্থা হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। স্যারের একমাত্র ছেলে রাজিব আমেরিকায় থাকে। ২৭ মার্চ দেশে আসবে। আমি ধারণা করেছিলাম রাজিব আসা পর্যন্ত অন্তত স্যার অপেক্ষা করবেন কিংবা আরও কিছু দিন আমাদের মাঝে থাকবেন। রাজিব আসলে স্যারকে আর একবার বাড়িতে দেখতে যাব। কিন্তু সে ভাগ্য আমার আর হলো না।
চিত্ত স্যার ছিলেন আমার হাইস্কুল পর্যায়ে পাঠ নেওয়া গিলাতলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। স্যার ছিলেন দর্শন শাস্ত্রে এম এ। ১৯৬৭-৬৮ সালে আমাদের স্কুল কম্পাউন্ডেই গিলাতলা কলেজ প্রতিষ্ঠার প্রথম দিকের সময় চিত্ত স্যারের জন্য কলেজে শিক্ষকতার অফার ছিল। কিছু দিন পড়িয়েছিলেনও। কিন্তু তার অন্তরে ছিল গিলাতলা হাইস্কুল। তিনি নিজেও এই স্কুলের ছাত্র ছিলেন। তিনি এ প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক হয়ে অবসরের আগ পর্যন্ত এ স্কুলের শিক্ষকতাকেই ব্রত জেনে পেশা হিসেবে নিয়ে নিলেন। ইস্ত্রি করা ধুতি-পাঞ্জাবি, কখনো কখনো স্যুট-বুট পরা দীর্ঘ দেহের সুদর্শন এ মানুষটির ব্যক্তিত্বই ছিল আলাদা। ইংরেজি, অঙ্ক, বাংলা সবকিছুতেই স্যারের দখল ছিল অসাধারণ।
১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও এ স্কুল থেকে স্যারের সময় আমি যশোর শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি পরীক্ষায় (১৯৭০ সালে) প্রথমবারের মতো ৮ম স্থান লাভ করি। স্যার আমাকে ছাত্রজীবন থেকেই ‘আব্বা’ সম্মোধন করতেন। এসএসসির রেজাল্টের পরে স্যারের সে আদর আর অহঙ্কার যেন অপরিমেয়ভাবে বেড়ে গিয়েছিল আর তা বজায় ছিল আমৃত্যু। সে কারণে বোধ হয় শেষ সময়েও শয্যায় শুয়ে নিকটজনদের কাছে জিজ্ঞেস করতেন— আমার সালাম কই? ১৮ মার্চ চিত্ত স্যারের চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল আমার পাঠশালা থেকে হাইস্কুল পর্যন্ত সব প্রধান শিক্ষকের চলে যাওয়া।
চিত্ত স্যার, নূরো স্যার, হাশেম স্যার, নিশিকান্ত মাস্টার মহাশয় আপনাদের সবাইকে অভিবাদন। আপনারা এখন যেখানেই থাকুন সেখানেই যেন শান্তিতে থাকুন। পরপারেও যেন আপনাদের পায়ের কাছেই আমার জায়গা হয়।
লেখক : ড. শেখ আবদুস সালাম
অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
E -mail:skasalam@gmail.com
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More