প্রচ্ছদ / কচিকাঁচা / কন্যাকে পিতা-৭: পুলু পাসিং | আহরার হোসেন

কন্যাকে পিতা-৭: পুলু পাসিং | আহরার হোসেন

Aharar-with-hisপ্রিয় ফুল,
৫ই এপ্রিল সকালবেলায় তুমি ঘটালে অবিস্মরণীয় এক ঘটনা। রাতের শিফটে অফিস শেষে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বাসায় ফিরেছি। দরজা খোলাই ছিল। তোমার মা তোমাকে কোলে নিয়ে গান করছে। তুমি হঠাৎ আমাকে দেখলে। তোমার চোখজোড়া উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হাসি বিস্তৃত হল আকর্ণ। প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়লে। মায়ের কোল থেকে নেমে যেতে উদ্যত হলে। অনেকটা সাঁতারের ভঙ্গিতে দরজার দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে। আমি দুয়ারে দাঁড়িয়ে মজা দেখছি। তোমার উত্তেজনা বেড়েই চলছে। তুমি হাতপা ছুঁড়ছো। এগিয়ে এসে কোলে তুলে নিলাম তোমাকে। তুমি আমার পেটের উপর চড়েই লাফাতে শুরু করলে। আর সেকি খিলখিল হাসি তোমার! তোমাকে থামানোই যাচ্ছে না। তুমি ততক্ষণ লাফালে যতক্ষণ ক্লান্ত না হলে। স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিলে আমাকে মিস করেছ তুমি। ওইদিন বিকেলে তুমি যখন তোমার মায়ের অফিস থেকে ফিরলে, আমাকে বাসায় দেখে একই কাণ্ড করলে। তার পরদিনও করলে। তার পরদিনও।

তুমি খুবই এক্সট্রোভার্ট। গত কয়েকদিন ধরে নতুন একটা খেলা তোমার সাথে খেলছি। আমি দরজা খুলে বাইরে যাওয়ার ভাণ করি, আর তুমি আমার কাছে আসার জন্য অস্থির হয়ে যাও। আমার ভারী আনন্দ হয়। তোমার এই ছোট ছোট কাণ্ড আমার হৃদয়ে যে কতটা দোলা দিয়ে যায়, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমি জানি শিশুরা যার কাছে ভালবাসা পায়, তার কাছে ফিরে ফিরে যায়। তোমার পাঙ্গা ভাইয়ের শৈশবে তাকে আমাদের কাছে কয়েকদিনের জন্য রেখে বিদেশে গিয়েছিল তার পরিবার। সেই সময়ে আমি অফিসে যাবার সময়ে প্রতিদিন একই কাণ্ড করত সে। গত সাড়ে ছমাস ধরে তোমার সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছি আমি। নিয়ত তোমার পরিবর্তন দেখছি। কিন্তু তোমার এখনকার এই পরিবর্তনটা আকাঙ্ক্ষিত হলেও অভাবনীয়।

আচ্ছা, তোমার সাথে আমার সম্পর্কটা কেমন হবে? বন্ধুর মতো? আমরা কি পরস্পরের সব গোপন কথা পরস্পরকে বলব? তুমি কি জান আমার বাবার সাথে আমার সম্পর্ক কেমন? একদম ভাল নয়। কিন্তু তাই বলে ভেবো না আমার বাবা আমাকে ভালবাসে না। বাবাকে আমি আব্বা বলি। তোমার দাদাভাই। তার কারণেই আজ আমি এই জায়গায়। নইলে এতদিন কোথায় ভেসে যেতাম। আমি যে এলাকায় যে সময়ে বড় হয়েছি, সেই এলাকায় সে সময়টাতে কেউ স্বপ্ন দেখত না। চারিদিকে ছিল দু:স্বপ্নে ভরা। আমার শৈশবের সবচাইতে প্রিয় বন্ধু বুলু স্বপ্ন দেখত বড় হয়ে গুণ্ডা হবে। তার একটা পিস্তল থাকবে। পরিণত বয়সে সে ছিল বাস ডাকাত। বুলু তার কর্মফল পেয়েছে। আরেকটু বড়বেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধুটি ছিল মাদকাসক্ত। কৈশোর পেরবার আগেই সে আত্মহত্যা করে। আমার বন্ধুদের গল্প তোমাকে আরেকদিন বলব। কিন্তু বুঝতেই পারছ, কেমন পরিবেশে বেড়ে উঠছিলাম আমি। এরকম পরিবেশে আমাকে ভাল কিছুর স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে তোমার দাদাভাই। গ্রামের তখনকার সামান্য রোজগেরে গৃহস্থ। বিস্তর খরচ করে আমাকে শহরে পড়তে পাঠিয়েছে। আর নিজেরা কষ্টেসৃষ্টে দিন পার করেছে। একজন পিতার যা যা দায়িত্ব হওয়া উচিত তার সবই পালন করেছে সে। কিন্তু কেন জানি তার সাথে সম্পর্কটা আমার সহজ হয়নি। আমি জানি আড়ালে সে আমাকে নিয়ে অনেক গর্ব করে। পুত্র হিসেবে পিতাকে নিয়ে আমারও গর্ব কম নয়। কিন্তু সামনে গেলেই দুজনেই ভাষা হারিয়ে ফেলি। আমাদের এই দুর্বোধ্য সম্পর্কের গোড়াপত্তন হয়েছে সম্ভবত আমার শিশুকালে। তোমার দাদুমণি আমাকে নিয়ে বছরের বেশীরভাগ সময় ঢাকায় কাটাত। ওদিকে গ্রামে আব্বার নতুন ব্যবসা। সেখানেই চলে যেত তার সব সময়। যে কটা দিন গ্রামে কাটাতাম তখনো আব্বার সাথে আমার নাকি দেখা হত না। সকালে আমি ওঠার আগেই আব্বা বেরিয়ে যেত। ফিরত যখন, আমি ঘুমিয়ে কাদা। এই করতে করতে আব্বা যে আমার কাছে কখন ‘আপনি’ হয়ে গেল টেরই পেলাম না। মা ঠিকই ‘তুমি’ হল। তার সাথে সম্পর্কটাও হল সহজ। আব্বার সাথে আমার সেতুবন্ধনের দায়িত্ব চাপল মায়ের কাঁধেই। আমার কিছু প্রয়োজন হলে মা-ই আব্বাকে জানাত। আর আব্বার কিছু বলার থাকলে সেটাও মা পৌঁছে দিত আমার কাছে। আজো ঘোচেনি এই দূরত্ব। আজো সেই মা-ই সেই সেতু। আব্বা বন্ধু হতে পারেনি, কিন্তু বাবা হতে পেরেছে ঠিকই। ওইসময় বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় পিতার সাথে সন্তানের আদর্শ সম্পর্ক সম্ভবত এমনতরই ছিল। আমি একটু বেশী চাই তোমার কাছে। আমি তোমার বাবাও হব, বন্ধুও হব। এখন পর্যন্ত সে পথেই হাঁটছি তুমি আর আমি।

তুমি এরই মধ্যে বেশ বেড়ে উঠেছ। তোমার নানাবিধ কাণ্ডকারখানা আমাকে আর তোমার মাকে বিমোহিত করে। এগুলোর মধ্যে কোন কোনটি দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত। একটি খেলা বেশ কৌতুককর। আমি এই খেলাটির নাম দিয়েছি ‘পুলু পাসিং’। তোমার মা তোমাকে একেক সময় একেক নাম ধরে ডাকে। তোমার এরকম গণ্ডায় গণ্ডায় নামের মধ্যে একটি হল পুলু। তুমি কখনো কখনো আমার কোলে উঠে তোমার মায়ের কাছে যাবার জন্য বায়না ধর। কিন্তু যেইনা তোমাকে তোমার মায়ের কোলে দিলাম সেই তুমি আবার আমার কোলে আসার বায়না ধরলে। এভাবে আমার কোল থেকে তোমার মায়ের কোল, সেখান থেকে আমার কোল। পৌন:পুনিক হারে চলতেই থাকে ‘পুলু পাসিং’। যতক্ষণ না তুমি ক্লান্ত হও ততক্ষণ।

তবে তোমার এই বুদ্ধিদীপ্ত সব কাণ্ড কীর্তি আমাকে আনন্দ দেবার পাশাপাশি কিঞ্চিত চিন্তিতও করে তোলে। এসবের অর্থ তুমি খুব দ্রুত বড় হচ্ছ। আর তোমাকে লেখা আমার প্রথম চিঠি থেকেই তুমি জান যে তুমি বড় হয়ে যাও তা আমি চাই না। হরেক কারণে চাই না। প্রধান কারণ হচ্ছে, বড় হলেই তোমাকে টিকে থাকার প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। আর বাংলাদেশে শিশুদের জন্য বড়দের তৈরি করে দেয়া এই প্রতিযোগিতা যারপরনাই নিষ্ঠুর। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর নানা প্রান্তেই তোমার মত শিশুদের জন্য মাইন ফিল্ডের মত পেতে রাখা হয়েছে নানাবিধ প্রতিযোগিতার ফাঁদ। এসব ফাঁদ যে কতভাবে তোমাদের শৈশব লুট করে নিচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। খবরের কাগজে আজই মুম্বইয়ের একটি ঘটনা পড়ে বেশ বিমর্ষ হয়ে রয়েছি। যে খবরে বলা হচ্ছে, চার বছরের ছোট্ট মেয়ে সারিকা তার পিঠের বিরাট স্কুল ব্যাগটির ওজন সামলাতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। আমি জানিনা এই সমাজ, এই বিশ্বকে জেগে উঠতে আর কত সারিকার বলিদান লাগবে। ফাঁদ এড়িয়ে বেঁচে থাক মা। পুলু পাসিংয়ে জীবন কাটিয়ে দাও।

আহরার হোসেনের ব্লগ থেকে…

About আহরার হোসেন

আহরার হোসেন, সাংবাদিক, বিবিসি বাংলা।