প্রচ্ছদ / খবর / আল্লাহকে স্মরণ করি, তখন বাঘের ঠোঁটে কামড় মারি (ভিডিও)

আল্লাহকে স্মরণ করি, তখন বাঘের ঠোঁটে কামড় মারি (ভিডিও)

After-tiger-attacaking-pic-01‘নদীর সাইডে একটা গোল গাছে হেলান দিয়া সকালে নাস্তা খাইতে বইসেলাম। হটাৎ কইরা পেছন থ্যইকা একটা বাঘ (রয়েল বেঙ্গল টাইগার) আইসা মোর সামনে দাঁড়ায়!’

‘বাঘডারে দেইখে পিলই ক্যাইপ্পা যাই। ভয়ে দ্রুত গোলে (গাছের) ট্যাগার (পাতা) নিচা ভুট হইয়ে শুইয়া পড়ি। সাথে সাথে বাঘ’ডা আমার মাথার নিচে ঘাড়ের উপর থাবা দেয়।’

‘বাঘ আমারে ঘাডা (থাবা) মালে (দিলে) আমি ওই বাঘের মুখের ভিতর হাত ঠুকাই দিছি। হাত ঠুকাই দিয়া জিবহা ধরছি।’

‘জিবহা ধরলে বাঘটা আমার হাতের তাড়া প্যাঁচাইয়া একটা কামড় মারছে। তখন মুখতে হাত বাইর কইরা থাবা দিয়ে দুই কান ধরছি বাঘের। বাঘের কান ধইরা বাঘের ঠোঁট প্যাঁচাইয়া কামড় দিছি।’

বাঘের মুখে পড়ার এ গল্প কোন রুপকথা বা কল্প-কাহিনী নয়। সুন্দরবনে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের (বাঘ) হাত থেকে বেঁচে ফেরা আব্দুস সামাদ হাওলাদার বুধবার (০৩ ডিসেম্বর) বিকালে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে এভাবেই বলছিলেন বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের ভয়ঙ্কর এ অভিজ্ঞতার কথা।

After-tiger-attacaking-pic-02বাগেরহাটের মংলা উপজেলার পশুর নদীর মংলা খেয়া ঘাট পাড়ে ষাট উর্ধ আব্দুস সামাদ হাওলাদারের সাথে দেখা হয় বাগেরহাট ইনফো-এর প্রতিবেদকদের সাথে।

তিনি জানান, ১৯৯১ সালের ১৬ জুলাই সুন্দরবনের করমজল সংলগ্ন ডাংমারী এলকায় তার উপর বাঘের এ হামলার ঘটনা ঘটে। ওই দিন সকালে এলকার আরো কয়েক জনের সাথে বনে কাঠ কটতে গিয়েছিলেন তিনি। সকাল আনুমানিক ১০টার দিকে নদী পড়ে বসে নাস্তা (চিড়া খাইতে) করতে গেলে বাঘ চলে আসে।

বাঘ তার উপর হামলা করলে এ দৃশ্য দেখে অন্যরা ভয়ে গাছে উঠে যায় জানিয়ে আব্দুস সামাদ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘বাঘের ঠোট কামড় দেওয়ার সময় এই তিনদা (৩টা) দাঁত বাঘের ঠোঁটে রইয়া গ্যাছে। তখন আমি উঠতে চাইলাম (বাঘের) পিঢের উপর, লাফাই হে (লাফ দিয়ে) সময়। তঅ (কিন্তু/তয়) পারিনাই।’

‘তখন ওই যে কামড়াই ধরছি, বাঘে চোখ প্যাচাইয়া থ্যাবা মারছে।’

পরে আমার চিৎকারে আশপাশের বাওয়ালিরা লাঠি শোটা লইয়ে চলে আইলে বাঘ বনের মধ্যে চইলে যায়।

দীর্ঘক্ষণ কথোপকথন এর ফাঁকে আব্দুস সামাদ হাওলাদার বাগেরহাট ইনফো ডকমকে জানান, তার বাড়ি সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার সাউথখালি ইউনিয়নের উত্তর সোনাতলা গ্রামে। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে তিনি হারিয়েছেন তার দু’চোখ।

After-tiger-attacaking-pic-03বর্তমানে তিনি মংলা খেয়া ঘাটে ভিক্ষা করে জীবন-জীবিকা নির্বাহ করছেন।

বাঘের সঙ্গে লড়াই করে মৃত্যু থেকে ফিরে আসা আব্দুস সামাদ আরো জানান, সুন্দরবন এলাকার আর দশজনের মতো এ বনের উপর ছিল তার জীবিকা। তবে বাঘের আক্রমণে পাল্টে গেছে তার জীবনের গল্প।

সেসময় কোথায় ডাক্তার দেখিয়ে ছিলেন জানতে চাইলে বাগেরহাট ইনফো ডকমকে তিনি বলেন, হের পর খুলনা আড়াইশ বেড হাসপাতালে ছিলাম এক মাস।

দুই ছেলে এক মেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে তার পরিবার। দুই ছেলে গ্রামে এবাড়ি ওবাড়ি দিন মজুরের কাজ করে। আর মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

নতুন জীবন পেয়ে বয়সের এই পড়ন্ত বেলায় এসে চাওয়া-পাওয়া কি, এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে একটু থেমে যান।

হয় তো মানুষের কাছে হাত পাততে ভালো লাগে না বলেই কিছু বিরক্তি নিয়ে তার জবাব, ‘কি আর চাই! আল্লার দয়ায় যদি কিছু টাহা পয়সা পাইতাম তাই দিয়া বাল-বাচ্চা নিয়া খাইতাম। ছেলে দু’ডারে তাই লইয়া একটু কিছু কইরা খাইতে কইতাম। ওরাতো এবাড়ি-ওবাড়ি মাডি কাডে, কাম হরে (করে)। ওদের কষ্ট একটু কমতো।’

After-tiger-attacaking-pic-04‘চোখে তো দেখেন না। তাহলে কে এখানে নিয়ে আসে?’- জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার একটা লোক আছে এই হানে। মংলা পোর্টে চাকরি করে। জলিল নামে সে এহ্যানে নিয়া আসে। এক সপ্তাহ থেইকে ১৫ দিন এহ্যানে থাহি। আবার বাড়ি যাইয়্যা কিছু দিন থাহি।

তিনি জানান, জলিল নামের ওই ব্যক্তিকে দৈনিক আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ আবার কখনো অর্ধেক পর্যন্ত দিতে হয়।

চির জীবনের মতো দৃষ্টিশক্তি হারালেও সুন্দরবনে বাঘের কবল থেকে বেঁচে ফেরা আব্দুস সামাদ হাওলাদার তার এ ঘটনা নিয়ে নিজেই বেঁধেছেন একটি গান।

কথা বলার শেষ প্রান্তে এসে তিনি আমাদের জানান সে কথা। আর গান শুনতে আবদার করলে কিছুটা গেয়েও শুনান তিনি। বাগেরহাট ইনফোর পাঠকদের জন্য তার সে গানের একটি সংগৃহীত ভিডিও যুক্ত করালো।

ভিডিও- 

কুদরতি সুন্দরবনে বাঘের সনে
ওই আমার জোর খাটে না
কুদরতি …

বেলা ১০টা বাইজে গেছে
ওরা সবাই কাজেই আছে
বেলা ১০টা বাইজে গেছে
ওরা সবাই কাজেই আছে

ওই আমার নাস্তার খুদা লাইগা গ্যাছে
সহ্য করতে আর পারি না
ও দয়াল, নাস্তার খুদা লাইগা গ্যাছে
সহ্য করতে আর পারি না…

কুদরতি সুন্দরবনে বাঘের সনে
আমার যোর খাটে না
কুদরতি…

ওই ওবাঘ ধীরে ধীরে আসতে আছে
ও তখন বইসা রইছে আমার পাছে
ওই আমি নাস্তা খাবার তালেই রইছি
ওই দিকে মোর চোখ ফেরে না

ও দয়াল, নাস্তা খাবার তালেই রইছি
ওই দিকে মোর চোখ ফেরে না
কুদরতি সুন্দরবনে বাঘের সনে
ওই আমার জোর খাটে না
কুদরতি …

যখন মুহে দিলাম হাত ভরি
হে তখন জিহবাডা ওই জোরে ধরি
ওই আমার হাতে যখন কামড় মারে
ওই হাতে আর জোর ঠেকি না

দয়াল, হাতে যখন কামড় মারে
ওই হাতে আর জোর ঠেকি না
কুদরতি সুন্দরবনে বাঘের সনে
ওই আমার জোর খাটে না
কুদরতি…

কি, আমি হাত বাহির করি
তখন থাবা দিয়া দুই কান ধরি
ওই শালায় থোতমা দিয়া চাইপা ধরে
পিঠেতে ওঠতে পারি না

কুদরতি সুন্দরবনে বাঘের সনে
ওই আমার জোর খাটে না
কুদরতি…

আমি আল্লাহকে স্মরণ করি
হে তখন বাঘের ঠোঁটে কামড় মারি
ওই আবার বাঘে শ্যাষে ব্যথা পাইয়া
থাবা দিলো চোখ প্যাঁচাইয়া

কুদরতি সুন্দরবনে বাঘের সনে
ওই আমার জোর খাটে না
কুদরতি…
কুদরতি…

০৪ ডিসেম্বর ২০১৪ :: মাহবুবুর রহমান মুন্না ও ইনজামামুল হক,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
এস/আই হক-এনআএডিটর/বিআই

About Inzamamul Haque