প্রচ্ছদ / খবর / ৩৭ বছর পর দেখা হলো মা ও মেয়ের

৩৭ বছর পর দেখা হলো মা ও মেয়ের

Mother-Son-Ma-May১৯৭৭ সালের জুন মাস। নূরজাহান বেগম ও মোহন গাজীর অভাবের সংসারে জন্ম নেয় তাদের পঞ্চম সন্তান জামিলা।

৩৭ বছর আগে নূরজাহান ও মোহন গাজী দম্পতির ‘নুন আনতে পানতা ফুরায়’ অবস্থা। এরই মধ্যে খুলনার দাকোপ উপজেলার চালনার গুনারী গ্রামে জন্ম হয় তাদের পঞ্চম সন্তান জামিলার।

শারীরিকভাবে অসুস্থ্য মোহন গাজী মেয়েকে দত্তক হিসেবে কাউকে দিতে চাইলেন। কিন্তু স্ত্রীর বাঁধায় তা আর পারেন না। জন্মের পাঁচ দিন পর জামিলাকে ঘরে বারান্দায় রেখে বাইরে ইট (খোয়া) ভাঙার কাজ করতে যান নূরজাহান বেগম। ফিরে এসে তিনি আর মেয়েকে পাননি!

স্বামী তাঁকে জানান, মেয়েকে ঘরের বারান্দা থেকে কেউ নিয়ে গেছে। মোহন গাজী তখন স্ত্রীর কাছে মিথ্যা বলেন।

আসলে তিনি মেয়েকে খুলনার এজি মিশনে নিয়ে ৫০০ টাকায় বিক্রি করে দেন। এর প্রায় আট মাস পর (১৯৭৮ সালে) মেরি ও পেট দম্পতি এজি মিশনে আসেন। তাঁরা জামিলাকে দত্তক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। বাংলাদেশী জামিলা হয়ে যান আমেরিকার এস্থার জামিনা জডিং।

দু’ভূবনেই ছিলো মা-মেয়ে। নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে অবশেষ দেখা হলো মা ও মেয়ের।

রবিবার (২৮ জুন) মায়ের দেখা পেয়ে সোমবার সারাদিনই বাবা-মায়ের সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন তিনি। কিন্তু কর্মস্থলে ফেরার তাড়া তো আছেই। তবে এ যাত্রা শুরুর যাত্রা। শিগগিরই স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে আবারো মায়ের কাছে মায়ের দেশে আসছেন জামিনা জডিং।

সোমবার (২৯ জুন) বাগেরহাটের মংলা উপজেলার বুড়িরডাঙ্গা ইউনিয়নের বালির মাঠ এলাকার নিজ বাড়িতে জামিনা সাংবাদিকদের জানান, ‘আমি ভীষণ খুশি। আমার এখানকার ৩ বোন, এক ভাই এরা সবাই খুব ভালো। আমার সবচেয়ে আপন মানুষ এরা। এদের কাছেই আমি আবার ফিরে আসবো।’

দীর্ঘ ৩৭ বছর পর মাকে কাছে পেয়ে এস্থার জামিনা জডিং বলেন, ‘মাকে পাওয়াটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। সন্তান হিসেবে মায়ের প্রতি যে দায়িত্ববোধ থাকা উচিত তাই আমি করবো। আর মাকে পাওয়ার আনন্দটা সবার সঙ্গে শেয়ার করার জন্য শিগগিরই আমার স্বামী-সন্তাানদের নিয়ে মংলায় আসবো।’

মংলায় তার অবস্থানকালে বালুর মাঠ গ্রাম যেন হয়ে উঠলো আনন্দ মাঠ। মা, ভাই-বোনসহ স্বজনদের পেয়ে জামিনা যেমন খুশী তেমনি তার স্বজনরাও আনন্দিত।

বোন আমিনা বেগম ও একমাত্র বড় ভাই আব্দুস সাত্তার জানান, হারিয়ে যাওয়ার দীর্ঘ ৩৭ বছর পর বোনকে ফিরে পেয়ে তারা খুবই খুশী। এতদিন ভাবতেই পারেনি তাদের বোন বেঁচে আছে। সে ফিরে এসেছে এটাই বড় প্রাপ্তি।

২৮ জুন মা-মেয়ের প্রথম দেখা হয় খুলনায়। এরপর তারা আসেন মায়ের বাড়ি মংলায়। সেখানে নিজের ৩ বোন ও রিকশা চালক ভাইয়ের সঙ্গে সারাদিন সময় কাটান জামিনা। সোমবার রাতেই তিনি ফিরে যান খুলনায়।

মঙ্গলবার (৩০ জুন) ঢাকার উদ্দেশ্যে খুলনা ছেড়েছেন তিনি। আগামী দু’এক দিনে ফিরে যাবেন যুক্তরাষ্ট্রে।

মা নূরজাহান বেগমের হারিয়ে যাওয়া মেয়ে জামিলা (জামিনা জডিং) এখন তিন সন্তানের জননী। তার স্বামী ল্যান্স জডিং পেশায় কেমিস্ট।

জামিনা জানান, ২০১৩ সালে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম টুইটারে মাধ্যমে তার পরিচয় হয় যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাংলাদেশী নওরীন ছায়রার ও পরে ফেসবুকে নওরীন ছায়রার ছোট বোন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী শিক্ষিকা নাহিদ ব্রাউনের সাথে। এরপর শুরু হয় শিকড়ের সন্ধান।

জামিনার সেই সময়ের বাংলাদেশী পাসপোর্টের সূত্র ধরে তাঁরা নিশ্চিত হন তাঁর বাড়ি খুলনার কোনো এক গ্রামে। জামিনার বিষয়ে নাহিদ তাঁর ফুফাতো ভাই খুলনায় কর্মরত আবু শরীফ হুসেন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন।

শরীফ হুসেন প্রায় এক বছর চেষ্টা করে বাগেরহাটের মংলায় জামিনার মা নূরজাহানের সন্ধান পান।

গত বছরের জানুয়ারি মাসে ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে এস্থার নিশ্চিত হন, নূরজাহান বেগমই তাঁর গর্ভধারিনী মা।

নূরজাহান বেগম বলেন, ওর বাবা ওই ঘটনার পর পালিয়ে যান। চার বছর পর ফিরে এসে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যান। তবে কোন সময়ই তিনি সত্য ঘটনা বলেননি। এক সময় বলতেন তোমার মেয়ে বেঁচে আছে ও তোমার কাছে এক সময় ফিরে আসবে। আমারও সব সময় মনে হতো আমার মেয়ে বেঁচে আছে।

‘ওর আসার খবর শোনার পর ঠিকমতো খেতে পারি না। রাতে ঘুমাতে পারি না। কখন আমার মেয়ের সঙ্গে দেখা হবে। আজ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি। আল্লাহ আমার স্বপ্ন পূরণ করেছে। বাকী জীবন আমি মেয়ে, জামাই ও নাতিদের জন্য দোয়া করে যাব ওরা যেন সুখে থাকে।’

এস্থার জামিনা জডিং বলেন, ‘আমি ভীষণ খুশি। মাকে দেখার অপেক্ষা আর সইছিল না। বারবার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। এ আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।’

জামিনার বন্ধু নাহিদ ব্রাউন ও শরীফ আহমেদ নিপু বলেন, ‘দুই বছর চেষ্টার পর মা-মেয়ের মিলন ঘটাতে পেরেছি। দীর্ঘ ৩৭ বছর পর ও শিকড়ের সন্ধান পেয়েছে। এই দিনটি সারা জীবন স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’

৩০ জুন ২০১৫ :: স্টাফ করেসপন্ডেন্ট,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
সুমন/আইএইচ/এনআরএ/বিআই

About বাগেরহাট ইনফো নিউজ