ইনজামামুল হক, নিউজ এডিটর । বাগেরহাট ইনফো ডটকম
আড্ডায় মুড়ি, নাস্তায় মুড়ি। কুড়কুড়ে, মুড়মুড়ে বাঙালীর পছন্দের এই মুখরোচক খাবার এক সময়ে তৈরি হতো বাড়িতে বাড়িতে। কিন্তু বাড়িতে মুড়ি তৈরির এমন চিত্র এখন দেখা মেলেনা খুব সহসা।
মিলের রাসায়নিক মেশানো মুড়ি খেতে খেতে; হাতে মুড়ি তৈরির কথাও এক প্রকার ভুলতে বসেছে শহুরে মানুষ। তবে বিভিন্ন এলাকায় এখনও টিকে আছে গ্রামিণ ঐতিহ্য হাতে মুড়ি তৈরি।
এমনই এক গ্রাম বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার কচুয়া সদর ইউনিয়নের ‘বারুইখালী’। এ গ্রামের প্রায় অধিকাংশের পেশা মুড়ি তৈরি। শতাধিক পরিবারের পেশা হিসাবে মুড়ি তৈরি এই গ্রামে শিল্প। গ্রামের মানুষের জীবন-জীবিকার সাথে মিশে আছে এ শিল্প।
সাম্প্রতি মুড়ি তৈরির গ্রাম বারুইখালী ঘুরে দেখা গেছে, দম ফেলার সময় নেই কারও। মুড়ি তৈরির কাজে ব্যস্ত গ্রামের অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা। বছর জুড়ে চাহিদা থাকলেও রমজান এলে তা বেড়ে যায় কয়েক গুন। তাই রোজার আগে থেকেই মুড়ি ভাজার ধুম পড়ে বারইখালী গ্রামে। দিন রাত সমানে চলছে এখন মুড়ি তৈরি।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বাড়িতে বাড়িতে এখন মুড়ি তৈরির ধুম। একদিকে চলছে ধান সেদ্ধ, ভেজানো ও উঠানে শুকানোর কাজ। অন্যদিকে পাশাপাশি চুলায় ভেজা চাল আর বালি উত্তপ্ত করে চলছে মুড়ি তৈরি। বারুইখলী গ্রামের প্রতিটি বাড়ির চিত্রই এখন এমন।
দুই যুগের বেশি সময় ধরে মুড়ি ভেজে জীবিকা নির্বাহ করে বারইখালি গ্রামের জয়ন্ত সাহা (৪১)। পৌত্রিক পেশা হিসাবে তার ছোট ভাই লিটন সাহাও একই কাজ করেন। যৌথ পরিবারে দুই ভাইয়ের স্ত্রী মনীকা রানী সাহা এবং শিল্পি রানী সাহাও যুক্ত পারিবারিক এ ব্যবসায়।
তাদের মতো গ্রামের কমপক্ষে একশ’ পরিবারের পেশা এই মুড়ি তৈরি।
জয়ন্ত সাহা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘মুড়ি তৈরির জন্য এই ধান আমারা কিনে আনি। তার পর শুকাই, সেদ্ধ করি। সেদ্ধ করার পর এই ধান ২ রাত ১ দিন পানিতে থাকে। তার পর আবার শুকায়ে বাজারে নিয়ে মিলের থেকে ভাঙায়ে চাল করি।’
‘এই চাল বাড়িতে এনে খুটে-বেছে (পরিস্কার করে) তার পর আমরা মুড়ির চুলা জ্বালি। এক ধারে বলি থাকে; এক ধারে চাল। চাল যখন ভাজতে ভাজতে একটু লাল হয়ে যায় তখন বালির ভেতর দিয়ে নাড়া দিলে মুড়িটা ফোটে।’
এই মুড়ি ভাজতি কোন প্রকার রাসায়নিক বা ক্যামিকেল দেয়া হয় না। শুধু মাত্র একটু লবন পানি দেওয়া হয় বলেন, জয়ন্ত সাহার স্ত্রী মনীকা রানী সাহা।
লিটন সাহা জানান, আমন মৌসুমে হুগলি, ছালট, গীগজ প্রভৃতি জাতীয় মোটা জাতের মুড়ির ধান সংগ্রহ করেন তারা। এক মন ধান থেকে (২৯ কেজি চাল) ২৩ থেকে ২৪ কেজি মুড়ি হয়। দিনে এক একটি পরিবার প্রায় ২৫ কেজি মুড়ি উৎপাদন করতে পারে।
‘৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজি দরে আমরা এই মুড়ি বিক্রি করি। পার্শবর্তী বাঁধাল বাজারেই এই মুড়ি বিক্রি হয়। মাঝে মাঝে বাড়ি থেকে এসেও মুড়ি কিনে নেয় পাইকাররা।’
তার দাবি, বর্তমানে জ্বালনি, মুড়ির ধানসহ অনান্য দ্রব্যের দাম বেশি হওয়ায় মুড়ির উৎপাদন খরচ বেড়েছে। পাশাপাশি বাজারে কম মূল্যে কারখানায় মেশিনে তৈরি মুড়ি পাওয়া যাওয়াতে তাদের লাভ কম হচ্ছে।
এই গ্রামের নিবাস চন্দ্র সাহা বলেন, আমাদের এই গ্রামের মুড়ি বাগেরহাট ছাড়াও পার্শবর্তি পিরোজপুর ও খুলনায় বিক্রি হয়। রোজার সময় চাহিদা বাড়ায় বরিশাল এবং ঢাকাও এই মুড়ি কিনে নেয় পাইকাররা।
বারুইখালী গ্রামের সাহাপাড়া এলাকার গবিন্দ সাহা বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, আগে এই এলাকার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মুড়ি ভাজা হতো। মেশিনের মুড়ি আসাতে গ্রামে মুড়ি উৎপাদন কমে গেছে। আমাদের গ্রাম ছাড়াও পার্শবর্তী চরকাঠি গ্রামের ১৫ থেকে ২০টি পরিবার এখনও মুড়ি তৈরি করে।
কচুয়ার বারুইখালী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শেখ সুলতান আলী বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় পেশাদার হিসাবে বিচ্ছিন্ন ভাবে মুড়ি ভাজার দৃশ্য হয়তো পাওয়া যাবে। তবে গ্রামের অধিকাংশ মানুষই এ পেশার উপর নির্ভরশীল বর্তমান সময়ে এমন গ্রাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
এখানকার মুড়ি তৈরির কারিগররা ঐতিহ্য ধরে রেখে কোন প্রকার রাসায়নিক ছাড়াই দেশিয় পদ্ধতিতে মুড়ি তৈরি করেন। কিন্তু উপকরনের দাম বেড়ে যাওয়ায় এবং মেশিনে তৈরি ভেজাল মুড়ির কারনে এ শিল্প হারিয়ে যেতে বসেছে।
সরকারি-বেসরকারি উদ্যেগে এখানকার মুড়ি তৈরির কারিগরদের প্রশিক্ষণ এবং সহজ শর্তে ঋণ প্রদান করা উচিৎ। পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি গ্রামীণ এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হবে।
এসআইএইচ/বিআই/২৬ জুন, ২০১৬
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More