প্রচ্ছদ / খবর / ছিলেন ঝুপড়িতে, পেলেন নতুন ঘর-ঠিকানা

ছিলেন ঝুপড়িতে, পেলেন নতুন ঘর-ঠিকানা

বিশেষ প্রতিনিধি, বাগেরহাট ইনফো ডটকম

সড়কের পাশে সুপারি বাগান। সেখানে গাছের ডাল আর লাঠিতে পলিথিন বেঁধে তৈরি ছোট্ট এক ঝুপড়ি। রোদ, ঝড়, বৃষ্টিতে গেল প্রায় তিন বছর ধরে সেখানেই থাকেন বাক প্রতিবন্ধী এক নারী। সঙ্গে একটি শিশু।

স্থানীয় কেউই জানেন না তাঁদের নাম, পরিচয়। সঙ্গে থাকা ছোট্ট ছেলে শিশুটির বয়স এখন প্রায় সাড়ে তিন বছর। আশপাশের মানুষ তার নাম দিয়েছে আবদুল্লাহ।

বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের বারাকপুর গ্রামে মা ও ছেলের ওই ছোট্ট ঝুপড়ি। জেলা সদর থেকে রামপালের ফয়লা মুখী সড়কের পূর্ব পাশের ছোট ঝুপড়ি দেখে বোঝার উপায় নেই, সেখানে কেউ থাকে। আশপাশ থেকে কুড়িয়ে আনা পলিথিন আর সুপারি পাতায় তৈরি ৩ ফুট–৫ ফুট ঝুপড়িটি উচ্চতায় প্রায় সাড়ে চার ফুটের মত। আশপাশে কাছাকাছি কোনো বাড়িঘরও নেই।

সোমবার হঠাৎ সেখানে হাজির হন জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। কথা বলতে না পারলেও আশপাশে গাড়ি আর মানুষ দেখে ওই নারী ও তাঁর শিশু সন্তানের চোখে মুখে ছিল বিস্ময়। সকলকে নিয়ে জেলা প্রশাসক ওই নারীর হাতে তুলে দেন উপহার সামগ্রী। জানান, তাঁর জন্য তৈরি হয়েছে নতুন ঘর। সেখানে নিয়ে যেতেই এসেছেন তাঁরা।

স্থায়ী একটি ঠিকানার পাশাপাশি ওই নারীকে একটি নামও দিয়েছে প্রশাসন। আনুমানিক ২৪-২৫ বছর বয়সী ওই নারীর নাম দেওয়া হয়েছে মরিয়ম বেগম। মরিয়ম ও আবদুল্লাহকে তাঁদের মালামালসহ গতকাল বিকেলে গাড়িতে করে নিয়ে যাওয়া হয় সদর উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের চাপাতলা গুচ্ছগ্রামে। সেখানে তাঁদের জন্য আগে থেকে তৈরি ঘরটি বুঝিয়ে দেন ইউএনও মো. তানজিল্লুর রহমান।

এর আগে বারাকপুর গ্রামে ওই নারীকে আনতে গিয়ে নতুন পোশাক, দুধ ও খাদ্যসামগ্রী দেয় উপজেলা প্রশাসন। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. কামরুল ইসলাম, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সরদার নাসির উদ্দিন, সদরের ইউএনও মো. তানজিল্লুর রহমান, মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন, ষাটগম্বুজ ইউনিয়ন চেয়ারম্যান শেখ আক্তারুজ্জামান বাচ্চু প্রমুখ।

স্থানীয় লোকজন জানান, বারাকপুর গ্রামের জনৈক শহিদুল ইসলামের সুপারি বাগানে ঝুপড়ি ঘর করে এক শিশু সন্তান নিয়ে থাকতেন বাক প্রতিবন্ধী ওই নারী।

বাগানের মালিক শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে কেউ থাকে না। বাগানে অনেক দিন পর পর আসা হয়।তিন বছর আগে এখানে রাস্তার পাশে একদিন ওই নারীকে প্রথম দেখি। কোলে একটি ছোট্ট বাচ্চা। তার কিছু দিন পর একদিন বাগানে এসে দেখি এক কোনে ঝুপড়ি করে আছে। সঙ্গে ছোট্ট বাচ্চা, কথা বলতে পারে না। অসহায় দেখে আমরাও ওই নারীকে তুলে দিইনি। তিনি কারও কোনো ক্ষতি করতেন না। সেই থেকে এখানে থাকেন। স্থানীয় লোকজন টুকটাক সহায্য করতেন, খাবার দিতেন।’

সদর উপজেলা মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান রিজিয়া পারভীন বলেন, শিশু সন্তান নিয়ে কিছুটা নির্জন ওই স্থানে ওই নারী থাকতেন। শিশুটি বড় হচ্ছে, আবার মা কথা বলতে পারে না। সবাই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কথা বলে ইউএনও তাঁদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করেছেন।

সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তানজিল্লুর রহমান বলেন, ‘এই নারী সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারি রামপাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছ থেকে। তিনি ওই পথ দিয়েই রামপাল থেকে বাগেরহাটে আসা যাওয়া করেন। কয়েক মাস আগে একদিন আমাকে জানালেন, বারাকপুরের ওখানে একটি সুপারি বাগানে এক অসহায় নারী বসবাস করেন একটি ঝুপড়ি ঘরের ভেতরে। সেখানে আমি গিয়ে দেখি, ওই নারীর কোনো পরিচয় কেউ জানেন না। আবার ওই নারীর সঙ্গে একটি ছোট্ট শিশুও আছে। শিশুটির পিতৃপরিচয় কেউ বলতে পারেন না।’

ইউএনও বলেন, ‘প্রথমে চেষ্টা করি, শিশুটিকে কোনো এতিম খানায় দেওয়া যায় কিনা, সে বিষয়ে খোঁজ নেই। কিন্তু কোনো মায়ের কোল থেকে সন্তানকে ছিনিয়ে নেওয়াটা ঠিক মেনে নিতেও পারছিলাম না। পরে মাথায় আসে, মা–ছেলের জন্য একটি ঠিকানার ব্যবস্থা করা যায়। আমাদের একটি গুচ্ছগ্রাম প্রকল্প চলছিল। সেখানে আমরা তাঁর জন্য একটি আধ–পাকা ঘরের ব্যবস্থা করি।’

তানজিল্লুর রহমান আরও বলেন, বিষ্ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে বলে এই নতুন ঠিকানায় ওই নারী ও তাঁর ছেলেকে জন্মনিবন্ধন কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। তাঁর জন্য ১০ টাকা কেজি দরের চালের কার্ডও করা হয়েছে। তাঁর চালের জন্য ওই টাকাও পরিশোধ করা হবে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে। এ ছাড়া এখানে তাঁর জন্য একজন স্থানীয় অভিভাবক নিয়োগ করা হযেছে। ভবিষতে যেন এই শিশুটিকে স্কুলে দিয়ে, তাঁকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে চেষ্টা অব্যাহত থাকবে।

জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ জানান, ‘ওই পরিচয়হীন বাক প্রতিবন্ধী নারীকে আমরা জেলা ও উপজেলা প্রশাসন মিলে নাম দিয়েছি মরিয়ম। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুয়ায়ী ছিন্নমূল মানুষের জন্য ঘর এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় যা যা সুবিধা আছে, আমরা তাঁর জন্য দেওয়ার চেষ্টা করছি। যাতে করে তিনি স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারেন। বিশেষ করে তাঁর শিশু যেন এই সমাজে স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে। তাঁর যে অধিকার, তা যেন নিশ্চিত হয়— সে ব্যাপারে আমরা সতর্ক ও সচেতন থাকব।’

এসআই/আইএইচ/বিআই/১২ মে, ২০২০

About Inzamamul Haque