প্রচ্ছদ / খবর / ধংস হতে দেব না আমাদের সুন্দরবন

ধংস হতে দেব না আমাদের সুন্দরবন

sundarban-longmarch-continue‘জান দেব, তবু ধংস হতে দেব না আমাদের সুন্দরবন।’ সুন্দরবনে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন, সরকারের সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে বাগেরহাটসহ উপকূলীয় এলকার মানুষের প্রতিবাদী কন্ঠে যেন একসূর।
প্রাকৃতিক দূর্যোগকালীন সময় মায়ের মতো আগলে রেখে সুন্দরবন উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের রক্ষা করে। কিন্তু রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবন সেই ভূমিকা পালন করতে পারবে না। বিদেশি কোম্পানির দখলদারদের কাছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কোনোভাবেই সুন্দরবনকে ধ্বংস করতে দেওয়া হবে না।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির মঙ্গলবার সকালে ঢাকা থেকে বাগেরহাটের রামপাল (সুন্দরবন) অভিমুখে লংমার্চ শুরু হওয়ায় বাগেরহাট ও খুলনাসহ দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা আরও প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছেন। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা চলছে মিছিল-মিটিং, সমাবেশ, সচেতনতামুলক সভা, দেওয়াল লিখন, আলোচনা সভা, মানববন্ধন, পোষ্টারিং, লিফলেট বিতরন, বিলবোর্ড স্থাপনসহ নানা কার্যক্রম। এলাকার সড়কগুলোর বিলবোর্ড এখন সুন্দরবন রক্ষা, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বাতিল আর লংমার্চ সফল করার স্লোগানে পরিপূর্ণ।
রামপাল অভিমুখে লংমার্চের মাধ্যমে আগতদের অভ্যর্থনা ও সমর্থন জানাতে সিপিবিসহ বাম জোট, সেভ দ্য সুন্দরবন, জনউদ্যোগ, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি, বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন, রামপাল কৃষি জমি রক্ষা কমিটি সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।
SundorBoneমঙ্গলবার ঢাকা থেকে শুরু হওয়া লংমার্চ ২৮ সেপ্টেম্বর রামপালের দিগরাজে মহাসমাবেশের মাধ্যমে পাঁচ দিনের কর্মসূচির সমাপ্তি হবে। সেখানে সুন্দরবন রক্ষায় জাতীয় কমিটি সুন্দরবন ঘোষণা পাঠ করবে। এ সমাবেশে সভাপতিত্ব করবেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির মংলা শাখার সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান।
সমাবেশে জাতীয় কমিটির আহবায়ক প্রকৌশলী শেখ মো. শহিদুল্লাহ, সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ, সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব ডা. আব্দুল মতিন, সিপিবির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমেদ, ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক বিমল বিশ্বাস, বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান ভূঁইয়া, তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জুনায়েদ সাকির উপস্থিতির কথা রয়েছে।
তবে সংগঠনের নেতারা লংমার্চে পুলিশের বাধার আশঙ্কা করছেন। কয়েকদিন আগে সিলেটে ও ঢাকার একটি কলেজে বাম সংগঠনের নেতাকর্মীদের ওপর সরকার-সমর্থকদের হামলার ঘটনায় বামনেতারা আশঙ্কা করছেন, লংমার্চেও হামলা হতে পারে এবং পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করতে পারে। বিশেষ করে রামপাল এলাকায় হামলার আশঙ্কা করছেন তারা।
রামপাল কৃষি জমি রক্ষা কমিটির সভাপতি সুশান্ত দাস বাগেরহাট ইনফোকে জানান, লংমার্চ হচ্ছে সরকার ও বিদেশি আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা। তাই সরকারের বাধার মুখে পড়ার আশঙ্কা করছি। ইতিমধ্যে শনিবার চুলকাঠি ও রোববার রামপালে পুলিশ প্রতিবাদ সমাবেশ করতে দেয়নি। এছাড়া এর আগে সমাবেশে ১৪৪ ধারাও জারি করেছে প্রশাসন।
Save Our SundorBon
তিনি জানান, বাধার আশঙ্কা থাকলেও তারা তাদের আন্দোলন থেকে পিছু হঁটবেন না। চোখের সামনে সুন্দরবন ধ্বংস হতে দিতে পারি না। প্রয়োজনে জীবন দেবো, তবু সুন্দরবন ধ্বংস হতে দেবো না।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির মংলা শাখার সভাপতি ও উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মো. নূর আলম জানান, আগের অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা করছি, লংমার্চে বাধা দেওয়া হতে পারে।
জীববৈচিত্র্যের আঁধার, পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। আর এ বনকে রক্ষা করতে আত্মঘাতী বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ লংমার্চে বাধা আসলে জনগণ তা প্রতিহত করবে।
স্থানীয়রা কেউ কেউ বলছেন, রামপালে আড়িয়াল বিলের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দাবিতে রামপাল-মংলায় ক্ষমতাশীন আওয়ামী লীগ মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছে। এ নিয়ে সহিংসতার আশঙ্কা করছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে, খুলনার দৌলতপুর থেকে বাগেরহাটের মংলা পর্যন্ত সড়কে পুলিশসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের মোতায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে বাগেরহাটের পুলিশ সুপার নিজামুল হক মোল্যা এখন পর্যন্ত আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কোনো আশঙ্কা করছেন না। তবে যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবেলায় তারা সচেষ্ট রয়েছেন।
তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, দেশব্যাপী গণজাগরণ দেখে আশা করছি, সরকারের সুবুদ্ধির উদয় হবে। সুন্দরবন রক্ষার জন্য তারা শান্তিপূর্ণ লংমার্চ পালন করছেন। এতে যদি বাধা আসে, তাহলে জনগণ তা প্রতিহত করবে। সেখানে তাদের করার কিছু থাকবে না।
তিনি  বিদেশী কোম্পানির দখলদারদের কাছে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি না দিতে সরকারের কাছে প্রতি আহ্বান জানান।
Deer-in-Bangladesh2উল্লেখ্য, বাগেরহাটের রামপালে সুন্দরবনের কাছে ১৩২০ মেগাওয়াটের একটি কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ পুরোদমে শুরু হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মিত হলে ঝুঁকিতে পড়বে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর ফলে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। আর এ কাজটি করতে গিয়ে সরকারের অন্তত চারটি দেশি-বিদেশি আইন ভাঙতে হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জমি নিয়ে স্থানীয় কৃষিজমির মালিকদের প্রবল বিরোধিতা রয়েছে। তবু বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) তাদের সিদ্ধান্তে অনড়। এ অবস্থায় হুমকির মুখে পড়েছে উপকূলীয় দুর্যোগের প্রাকৃতিক ঢাল সুন্দরবন। একই সঙ্গে পৃথিবীর বিরল প্রজাতির গাঙ্গেয় ও ইরাবতী ডলফিন হারিয়ে যাবে, মরে যাবে পশুর নদী, বাড়বে খুলনা অঞ্চলের লবণাক্ততা।
বন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞ খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. নাজমুস সাদাত বলেন, উন্নয়নের স্বার্থে বাংলাদেশেও এখন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প দরকার। কিন্তু যদি এটা হয় বিশ্ব ঐতিহ্যের ধারক সুন্দরবনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যানগ্রোভ বনের কাছে, তাহলে বিপদের শেষ নেই।
তিনি আরও বলেন, কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, বিভিন্ন ক্ষুদ্র কণিকা, মারকারি বা পারদ, আর্সেনিক, শেলেনিয়ামসহ পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিভিন্ন উপাদান নির্গত হয়। কয়লা পুড়ে ছাই তৈরি হয় এবং কয়লা ধোয়ার পর পানির সঙ্গে মিশে তৈরি হয় আরেকটি বর্জ্য কোল স্লাজ বা স্লারি বা তরল কয়লা বর্জ্য। ছাই এবং স্লাজ উভয় বর্জ্যই বিষাক্ত। কারণ, এতে বিষাক্ত আর্সেনিক, মার্কারি বা পারদ, ক্রোমিয়াম এমনকি তেজস্ক্রিয় ইউরোনিয়াম ও থোরিয়াম থাকে। এতে মানবদেহের যেমন ক্ষতি হয় তেমনি বন ও বন্যপ্রাণীরও ক্ষতি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি (প্রা.) লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ভি এস তাম্রাকার জানান, সুন্দরবন সংলগ্ন বাগেরহাটের রামপালে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে পরিবেশ ও সুন্দরবনের ক্ষতি হবে না। সুযোগ সৃষ্টি হবে এ অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থানের। এখানে অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মতো তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হবে। সেখানে উন্নতমানের কয়লা ব্যবহার করা হবে। ফলে বাতাসে সালফারের পরিমাণ থাকবে খুবই কম। অনেকেই বুঝে, না বুঝে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন।
তিনি জানান, উন্নত দেশে পরিবেশগতভাবে এ ধরনের কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৩ :: মাহবুবুর রহমান মুন্না ও ইনজামামুল হক,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।

About ইনফো ডেস্ক