• পলাশ কুমার পাল
সাধারণ মানুষের অসাধারণ চিন্তা আর স্বপ্নের দেশ আমাদের বাংলাদেশ। বর্তমানে চলমান নানা ঘটনায় অস্থিরতা, হতাশা, দু:শ্চিন্তা, ভয় আমাদের সকলকে প্রায় গ্রাস করেছে। জঙ্গী, আই-এস, সন্ত্রান, দুর্নীতি, চুরি, হত্যা, খুন, ধর্ষন এমন কতগুলো শব্দের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি আমরা।
কয়েকদিন আগের ছোট একটিা ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই। বাসার পাশে স্কুলের খেলার মাঠে বসে আছি। পড়ন্ত বিকাল, চারিদিকে মৃদুমন্দ হাওয়া। গোধূলী বিকেলের রক্তিম আভায় আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে সবার মুখ।
এমন বিকালকেই মনে হয় বলে কনে দেখা গৌধূলী। এমন গৌধূলীর বর্ণনা হয়তো আমরা গল্প, উপন্যাসে পড়েছি বহুবার। এমন গোধূলীতে বাংলার নারীদের আরও সুন্দর লাগে। এমন ভাবনা থেকেই হয়তো এর নাম দেওয়া হয়েছে কনে দেখা গোধূলী। বন্ধুদের সাথে নানা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিল।
হঠাৎ একটা বিকট শব্দ। সবাই কেপে উঠলো, চোখ ঘুরলো শব্দের উৎসের দিকে। তেমন কিছু নয় রিকশার টায়ার ফেটেছে। কিন্তু শব্দের সাথে সাথে মাঠে ফুটবল খেলতে থাকা কয়েকজন বলে উঠলো জঙ্গী-জঙ্গী, অন্য দুই এক জন আইএস- আই এস। তারপর সবাই হেসে উঠলো। মনে হলো উপস্থিত সকলেই যেন আই-এস বা জঙ্গী সম্পর্কে জানে।
আমি একটু অবাক হয়েই দেখলাম সেখানে ২য়, ৩য়, ৪র্থ শ্রেণিতে পড়ে এমন বাচ্চারাও আছে। মাঠে খেলা শেষ হতে আমি ছোট এক ছেলেকে ডাকলাম, জানলাম সে ২য় শ্রেণিতে পড়ে।
আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম তুমি জানো জঙ্গী, আই-এস এসব কি? সে একটু হেসে আমাকে বললো “হু—হু। শুধু আমি নই, আমার বন্ধুরাও জানে”। কী জানে, জানতে চাইলাম আমি। বললো, সন্ত্রাসী, সবাইকে মারে… ইত্যাদি। এসকল শিশুরা কিভাবে জানলো? হয়তো টিভিতে দেখেছে না হলে মা-বাবা, পরিবারের কাছ থেকে শুনেছে।
কিছু দিন আগে পেপারে একটা খবর দেখেছিলাম। এস.এস.সি পাশ করা কয়েকজন তরুণ-তরুণীকে বাংলাদেশের ইতিহাস এবং নানা সাধারণ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তারা উত্তর দিতে পারেনি। এর জন্য কি শুধুই ওই সকল ছাত্র-ছাত্রীরা দায়ী? এই দায় কি বাবা-মা, পরিবার, শিক্ষক, গনমাধ্যম তথা সমাজের নেই? আমরা এই ছাত্র-ছাত্রীদের বিষয়গুলো জানাতে পারিনি বা তাদের এই বিষয়ে আগ্রহী করতে পারিনি। কারন আমার মনে হয় আমরা হয়তো গুরুত্বের সাথে তা চাইনি। আমরা শুধু চেয়েছি “জি.পি.এ-৫” বা “এ+”। তবেই সবাই খুশি।
শিশুরা যদি টিভিতে দেখে বাবা-মা এর কাছ থেকে শুনে জঙ্গী বা আই-এস এর সম্পর্কে জানতে পারে তবে তারা কেন বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি জানতে পারবে না?
তাহলে বুঝতে হবে পরিবার, গণমাধ্যম তথা সমাজ বা রাষ্ট্রেরও দায় আছে। আমাদের সকলকে এই বিষয়গুলো নিয়ে গুরুত্বের সাথে ভাবতে হবে।
যে বিষয় লিখবো বলে বসেছিলাম তার থেকে মনে হয় একটু দুরে সরে এসেছি। এই বাংলার মাটিতে অনেক অসাধরণ মানুষ জন্মেছেন, না মনে হয় ভুল বললাম কারন মানুষতো আর অসাধরণ হয়ে জম্মায় না, মানুষ দিনে দিনে অসাধরণ হয়ে ওঠেন। সেই সাধারণ মানুষদের অসাধারণ হয়ে ওটার যাত্রায় আমাদের সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন বিশেষ করে বাবা-মা।
এই বাংলার মাটিতে জন্মেছেন এবং আলো বাতাসে বেড়ে উঠেছেন জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, তাজউদ্দিন আহম্মদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, দার্শনিক গোবিন্দ চন্দ্র দেব, শহীদুল্লাহ কায়সার, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বেগম রোকেয়া, জগদীশ চন্দ্র বসু, প্রফুল্ল চন্দ্র রায়, এফ.আর.খান, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, মুহম্মদ কুদরত-ই- খুদা, ফকির লালন শাহ, হাসন রাজা, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খা, শাহ আব্দুল করিম, জয়নুল আবেদিন, মুস্তফা মনোয়ার, হীরালাল সেন, জহির রায়হান, ঋত্বিক ঘটক, জামিলুর রেজা চৌধুরী, ড. মোহাম্মদ ইউনুস, ফজলে হাসান আবেদ, জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, আব্দুল্লাহ আবু সাইদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল এমন আরও অনেক গুনী মানুষ।
তাদের অনেকেই আজ আমাদের মাঝে নেই। কেউ কেউ আছেন। কিন্তু তাদের সকলের কৃর্তি আমাদের মাঝে বর্তমান। এই সকল বাঙ্গালীর অসামান্য কর্মগাথা আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়, সাহস দেয় জীবনের পথে ছুটে চলার। দেশেপ্রেমের মন্ত্র আমরা পাই তাদের কাছ থেকে। আমাদের শিশু, কিশোর, তরুণদের জানাতে হবে এই সকল মহান মানুষদের ত্যাগ, গৌরব এবং জ্ঞানের কথা। এতে তারা অনুপ্রেরণা পাবে। আলোর পথে হাঁটতে শিখবে। এই পথ চলা ধিরে হতে পারে, কিন্তু এই চলা তাদের সাধারন থেকে অসাধারনের পথের যাত্রা আরও
বেগবান করবে। এতক্ষন যাদের নাম উল্লেখ করলাম, আমরা প্রায় সকলেই তাদের সম্পর্কে জানি। কিন্তু সমাজে এমন অনেক মানুষ আছেন যারা সমাজের জন্য কাজ করে চলছেন নি:শব্দে, নিরবে।
আমরা কি পালন সরকার, কার্তিক প্রমানিক কিংবা মুদাব্বির মত মানুষদের নাম জানি বা জানতে চাই?
পলান সরকার ৭৫ উর্ধ্ব একজন বৃদ্ধ মানুষ, বাড়ি রাজশাহীতে। এই মানুষটি গ্রামে গ্রামে ঘুরে মানুষকে বই পড়তে উৎসাহিত করেন এবং নিজের টাকায় কেনা বই বিনা পয়সায় সকলকে পড়তে দেন এবং পড়া শেষে তা বদল করে আরও বই দিয়ে আসেন। এই বৃদ্ধ মানুষটা সারা দিন রোদে, বৃষ্টিতে ভিজে আমাদের জন্য আলোর মশাল বয়ে নিয়ে বেড়ান।
কার্তিক প্রমানিক। বাড়ি চাপাই নবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার টুটপাড়া গ্রামে। ৭৮ বছর বয়স্ক এই মানুষটি পেশায় একজন কৃষক। কৃষিকাজ থেকে উপার্জিত সামান্য অর্থ তিনি পরের জন্য ব্যয় করেন কিন্তু একটু অন্যভাবে। তিনি নিজের টাকায় কেনা গাছ গ্রামে গ্রামে ঘুরে ঘুরে সেগুলো লাগান। রাস্তার পাশে। স্কুলের মাঠে, অন্যের বাড়ির আঙ্গিনায়। গ্রামের বিভিন্ন ফাকা স্থানে তিনি গাছ লাগিয়েছেন সেই যুবক বয়স থেকে। এটা তার একটা আন্দোলন। পরবর্তী প্রজম্মের জন্য সবুজ পৃথিবী রেখে যাবেন এটাই তার একমাত্র কামনা।
এদের আর একজন মুদাব্বির হোসেন। পেশায় দলিল লেখক। পত্রিকা পড়া তার শখ। ১৯৬৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তিনি নিয়মিত পত্রিকা পড়ছেন এবং তা সংরক্ষণ করেন। তিনি এই পত্রিকার একটা সংগ্রহশালা তৈরী করবেন এবং সকলকে পত্রিকা পাঠে উদ্বুদ্ধ করবেন। তার এই সংগ্রহশালা থেকে সবাই নানা ধরনের জ্ঞান অর্জন করবেন এবং অতীত জানতে পারবেন এটাই তার কামনা।
‘‘এই মানুষগুলোর কাজ খুব সাধারণ মনে হতে পারে কিন্তু এই সাধারণ কাজগুলোই পৃথিবীতে বড় পরিবর্তন আনবে।”
মানুষের প্রতি রইল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা এবং শুভ কামনা এই সকল মানুষদের জীবনের গল্প যখন জানতে পারি তখন আমরা জীবনকে ভিন্ন ভাবে দেখার অনুপ্রেরনা পাই। বর্তমান সময়ের আধুনিক বাবা-মায়েদের প্রতি আমার অনুরোধ আপনারা সন্তানদের ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, বিসিএস ক্যাডার হওয়ার পাশাপাশি যেন ‘পালন সরকার’ বা ‘কার্তিক প্রমানিক’দের মত মানুষ হওয়ার উৎসাহ দেন। তাহলে তারা দেশের জন্য মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করবে অনুপ্রেরণা আরও বেশি করে পাবে।
অনুপ্রেরনা সকল অন্ধকার, অন্যায়, নিষ্ঠুর কাজ থেকে দুরে রাখবে বলে আমি বিশ্বাস করি গনমাধ্যমকে ধন্যবাদ এই মানুষদের সবার সামনে তুলে ধরার জন্য। তাদের এই কাজ ছড়িয়ে পড়ুক। আমাদের সমাজের চারপাশে এমন আরও মানুষ হয়তো আছেন কিন্তু আমরা জানি না। এই সকল মানুষদের তুলে আনতে হবে এবং যথাযথ স্বীকৃতি দিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না আমাদের দেশের অর্থনীতি কৃষক, প্রবাসী শ্রমিক এবং অতি দরিদ্র গার্মেন্টস কর্মীদের ঘামের উপর শক্তভাবে দাড়িয়ে আছি। এই মানুষদের যথাযথ সম্মান দিতে হবে।
অতি সাধারন এই মানুষদের কি অসাধারন সব চিন্তা আর কাজ। এই সকল অসাধারন চিন্তাশীল দেশপ্রেমিক মানুষদের কথা শুনতে শুনতে, পড়তে-পড়তে বড় হওয়া শিশু-কিশোররা এক সময় তাদেরকে জীবনের অনুপ্রেরনা হিসাবে নিতে শুরু করবে এবং এই শিক্ষাই তাদের সন্ত্রাস। অন্যায় তথা সকল খারাপ কাজ থেকে দুরে নিয়ে যাবে। আমাদের শিশুরা, তরুনরা আর জানবে না বা জানতে চাই না জঙ্গী কি ? আই-এস কি বা সন্ত্রাসী কি? কারন তাদের সামনে আমরা উপস্থাপন করবো এই সকল দেশপ্রেমিক, নি:স্বার্থ, পরোপকারী মানুষদের জীবন গাথা।
জাফর ইকবাল স্যারের একটা লেখায় একবার পড়েছিলাম, শিশুরা নাকি সবই বুঝতে পারে। স্যার বলেছেন, একে বারে ছোট্ট অবস্থা থেকে তাদের বইয়ের সাথে, পড়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কথা। শিশুদের পাশে বসে জোরে জোরে বই পড়ার কথা। শিশুরা নাকি এই পড়ার সাথে আস্তে আস্তে একাত্য হয়ে যায়। তখন শিশুর কান্না থামানোর জন্য, খাওয়ানোর জন্য, হাসানোর জন্য প্রধান হাতিয়ার হয়ে ওঠে এই অভ্যাস।
কারন অভ্যাসের সাথে শিশু মনের মিথস্ক্রিয়া ঘটে। এই শিশু দিনে দিনে বড় হয়ে ওঠে এবং বইয়ের সাথে একটা গভির সম্পর্ক তৈরি হয়। এই অভ্যাসের চর্চা করে দেখতে পারি আমরা। আমাদের শিশু, কিশোর, তরুনদের ইতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে জীবনকে দেখতে শেখাতে হবে। জীবনে অনেক হতাশার, খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হতেই পারে কিন্তু আমরা জানবো রাত যত গভীর হয় ভোর ততই নিকটে আসে।
হতাশা, ব্যর্থতা, অন্যায়ের অন্ধকার যতই গাঢ় হোক না কেন সাফল্য আর আশার সূর্য অবশ্যই উঠবে।
Bagerhat Info Largest Bagerhat Online Portal for Latest News, Blog, Informations & Many More