প্রচ্ছদ / খবর / অধিগ্রহণকৃত জমি মালিকের ‘বাড়ি গিয়ে’ ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান

অধিগ্রহণকৃত জমি মালিকের ‘বাড়ি গিয়ে’ ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান

ক্ষতিপূরণ প্রদানের যেন কেউ হয়রানির শিকার না হয় তালুকদার আব্দুল খালেক

নিজস্ব প্রতিবেদক, বাগেরহাট ইনফো ডটকম

অধিগ্রহণকৃত জমি মালিকের বাড়িতে গিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক প্রদান। হোগলডাঙ্গা, রামপাল, বাগেরহাট, ২৬ নভেম্বর। ছবি: বাগেরহাট ইনফো ডটকম।

বাগেরহাটের রামপালে খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে নতুন করে অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদানে স্বচ্ছতা আনতে ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়িতে গিয়ে চেক প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছে জেলা প্রশাসন।

মঙ্গলবার (২৬ নভেম্বর) রামপাল উপজেলার হোগলডাঙ্গা গ্রামের সাক্কাত উল্লা শেখের বাড়ি গিয়ে ক্ষতিপূরণের চেক তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করা হয়। চেক তুলে দেন খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেক এবং বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি সদস্য বাগেরহাট-২ আসনের সাংসদ শেখ তন্ময়।

এ উপলক্ষে বিকেলে হোগলডাঙ্গা দাউদ মল্লিক হাফেজিয়া মাদ্রাসা মাঠে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন, পুলিশ সুপার পংকজ চন্দ্র রায়, ক্ষতিগ্রস্থ জমি মালিক হোগলডাঙ্গা গ্রামের সাক্কাত উল্লা, গোবিন্দপুর গ্রামের গৌরাঙ্গ পাল প্রমুখ।

ক্ষতিপূরণের চেক বিতরণ। ছবি: বাগেরহাট ইনফো ডটকম।

অনুষ্ঠানস্থল আশপাশের গ্রামসহ পুরো এলাকা ধরেই অধিগ্রহণ করা হচ্ছে বিমান বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে। যার পুরটাই ঘন বসতিপূর্ণ। ক্ষতিপূরণের অর্থের চেয়েও সেখানকার বেশি ভাগ মানুষ চিন্তিত তাদের মাথা গোজার জায়গা নিয়ে। বসত ঘর, গাছপালা ও জমির জন্য যে টাকা তাঁরা পাবেন ‘তা দিয়ে নতুন জমি কিনে ঘর নির্মাণ সম্ভব হবে না’, বলছেন স্থানীয়রা।

হোগলডাঙ্গা গ্রামের প্রয়াত ইউসুফ আলী শেখের স্ত্রী রাবেয়া বেগম। অনুষ্ঠানস্থলের দক্ষিণ পাশের প্রথম বাড়িটি তাঁদের। স্বামীর কবরও সেখানেই। বিকেলে বাড়ির সামনেই বসে ছিলেন তিনি। অধিগ্রহণ, ক্ষতিপূরণ নিয়ে কথা বলতে দীর্ঘ কষ্ট আর ক্ষোভের কথা তুলে ধরেন পঁচাত্তর উর্ধ্ব ওই নারী। বলেন, ‘আমাদের তো এখান থেকে উচ্ছেদ করে দিচ্ছি।’

কোথায় যাবো, কি করবো প্রশ্ন রেখে বলেন, এখানে একটা গ্রাম, আত্মিয়-প্রতিবেশি সবাই এক সাথে থাকতাম। এখন গ্রামের সবাই ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাবে। আলাদা হয়ে যাবে।

‘প্রথমে আমাদের বলেছিল জমির দামের তিনগুন টাকা দিবে ক্ষতিপূরণ। এখন দিচ্ছে দেড়গুন। কিন্তু আমরা এ দিয়ে কি করবো। এই টাকা দিয়ে কি জাগা কেনবো, না ঘর বানবো। আমাদের তো কোন থাহার জাগাও দিচ্ছে না। এখন তো আমাগো গলায় দড়ি দিয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।’

রাবেয়া বেগম।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, হোগলডাঙ্গা মৌজায় বিঘা প্রতি ৭ লাখ টাকা দেওয়া হচ্ছে। তবে ওই টাকা অন্য এলাকায় জমি কেনা সম্ভব নয় বলে দাবি তাদের।

ওই এলাকার আলী আসরাফ শেখ বলেন, এখানে জমি যাচ্ছে সবার। বাপ-দাদার ভিটা। সরকারের প্রয়োজনে জমি নিক, কিন্তু আমরা চাই এই জমি নিলেও এখানে কাছাকাছি কোন এলাকায় আমাদের থাকার একটা ব্যবস্থা করা হোক। কারণ এই এলাকা আমাদের পরিচিত।

দূরে কোথাও না দিয়ে আমাদের এই এলাকায় সরকারি খাস জমিতে পুরনর্বাসন করা হোক।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য তালুকদার আব্দুল খালেক বলেন, আশপাশের অনেক এলাকার চেয়ে এখানে জমির দাম কম। তাই যে হারে ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়া হচ্ছে তা দিয়ে নতুন করে জমি কিনে বসবাস অনেক কঠিন। তাই আমি বলবো যদি এই এলাকার কাছে সরকারি কোন খাস জমিতে থাকে সেখানে এই লোকদের পূনর্বাসন করা গেলে স্থানীয় মানুষ খুসি হবেন। প্রশাসন সেই উদ্যোগও নিচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ক্ষতিপূর্ণ প্রদানের যেন কেউ হয়রানির শিকার না হয়। অনেকেই অবৈধ সুবিধা নিতে চায়। আপনারা কেউ টাকা দিবেন না। ঘুস দিবেন না। যদি কেই টাকা-পয়সা চায় আপনারা গোপনে জেলা প্রশাসককে জানাবেন, আমাকে জানাবেন। তার পর যা ব্যবস্থা নিতে হয় আমরা নিবো, ইনশাল্লাহ।

জেলা প্রশাসক মামুনুর রশীদ বলেন, ক্ষতিপূর্ণের টাকা প্রদানে আমরা স্বচ্ছতার আনতে ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে চেক বিতরণের উদ্যোগ নিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী যান সেবা জনগনের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে।

এখন থেকে আর কাউকে টাকা আনতে ডিসি অফিসে যেতে হবেনা। আমরা ক্ষতিগ্রস্থদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চেক পৌঁছে দিবো। অধিগ্রহণকৃত জমির মালিকদের যেন খাস জমি বরাদ্দ দিয়ে ঘরসহ তাদের পুনর্বাসন করা যায় এ জন্য আমরা একটি প্রকল্প তৈরি করছি। যাতে এখানকার মানুষের দাবি পুরণ হবে।

অনুষ্ঠানে ওই এলাকার অধিগ্রহণকৃত ৩৩ জন জমি মালিককে ক্ষতিপূরণের ৮৯ লাখ ৮৫ হাজার ৬৯৩ টাকার চেক প্রদান করা হয়।

১৯৯৬ সালে বাগেরহাট জেলার রামপাল উপজেলার ফয়লা এলাকায় বিমান বন্দর নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সরকার। ওই বছরের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া খানজাহান আলী বিমান বন্দরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

তখন একটি শর্ট টেক অফ ল্যান্ডিং বন্দর হিসেবে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৯৯ একর জমির অধিগ্রহণ করে মাটি ভরাটসহ কিছু কাজও হয়। তবে পরবর্তিতে দীর্ঘ সময় এই বিমান বন্দর নির্মাণকাজ বন্ধ ছিল।

খানজাহান আলী বিমান বন্দর নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. শহীদুল আফরোজ বলেন, শর্ট টেক অফ ল্যান্ডিং এর ছোট বিমানগুলো বন্ধ হতে থাকায় পরবর্তীতে একটি পূর্ণাঙ্গ অভ্যন্তরীণ বিমানবন্দর নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়। সে জন্য আরও ৫২৯ একর জমির দরকার ছিল। নতুন করে সেই জমি অধিগ্রহণের ফলে প্রকল্পের মোট জমির পরিমান এখন ৬৩০ একর।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, খুলনা-মোংলা মহাসড়কের পাশে ফয়লা এলাকায় বিমান বন্দরটির জন্য ১৯৯৭ সালে ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কিছু মাটি ভরাট কাজের পর নির্মাণকাজ বন্ধ হয়ে যায়। ২০১১ সালের ৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটিকে পূর্ণাঙ্গ বিমান বন্দরে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি দেন।

২০১৩ সালের এপ্রিলে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (কুয়েট) সম্ভাব্যতা যাচাই করার দায়িত্ব দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর কুয়েটের বিশেষজ্ঞরা তাদের প্রতিবেদন জমা দেন।

বিমান বন্দরটির নির্মাণকাজ শেষ হলে এই অঞ্চলের পর্যটন, ব্যবসাবাণিজ্যসহ সর্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে বলে আশা সংশ্লিষ্টদের।

এসআই/আইএইচ/বিআই/২৬ নভেম্বর, ২০১৯
** বিমান বন্দরের জন্য আরও ৫২৯ একর জমি

About Inzamamul Haque