প্রচ্ছদ / লেখালেখি / শিল্প-সাহিত্য / গল্প / একটি ঘরের আত্মকাহিনী | মাসুমা রুনা

একটি ঘরের আত্মকাহিনী | মাসুমা রুনা

• মাসুমা রুনা

House-imageআমার বারান্দা, আমার উঠোন, আর আমার ঘরের মেঝে তে এক সময় মানুষ ভরতি ছিল। আর এখন কেউ নাই। আছে কিছু মাকড়শা, টিকটিকি, আর কিছু সাপ। ইদানিং, ঘুণপোকারা কুটকুট করে আমার খুঁটি গুলো তে অবিরাম তার কাজ করে যাচ্ছে।

আমি খুব গর্ব করতাম এক সময় আমার মালিক একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ ছিলেন। আর মানুষের প্রানের বন্ধু ছিলেন। এক ই সাথে শহর ও গ্রামে দুজায়গায় সুনামের সাথে তার দায়িত্ব সারাজীবন পালন করে গেছেন। তার আশেপাশে সবসময় ছায়ার মত ছিল ভক্ত অনুরাগী রা। সবার জন্য নিজেকে অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছিলেন আমার মালিক। তার ছেলেমেয়ে রা ঘরবাড়ী হইচই করে মাতিয়ে রাখত। আর একজন পুরো বাড়ী টার যত্ন নিত। ঠিক যেন তার আর একটি সন্তান এর মত। ছেলে-মেয়েদের তিন বেলা খাওয়া দাওয়া করানো, পড়াশুনা, স্বাস্থ্য আর চরিত্রবান বানানো যেমন যত্ন নিয়ে করত আমার মালকিন, ঠিক তেমনি আমার যত্ন নিত। আমার মেঝে আর আমার উঠোন ঝাড় দেয়া, আমার গায়ের মাকড়শার জাল ঝেটিয়ে বিদায় করা, শীত গ্রীষ্ম আর বর্ষা তে আলাদা আলাদা খেয়াল রাখা। ইস ! কি আদর আর যত্নেই না ছিলাম!

একসময় আমার সুখে নজর লাগলো। মালিক আমার চিরতরে চলে গেল। গ্রামবাসী, শহরবাসী যারা তাকে চিনত সবাই কাঁদল। আমিও কাঁদলাম।

কিন্তু আমিতো একটা কাঠের ঘর, তাই আমার কান্না কেউ টের পেল না! আমার মাথার উপরে ত টিনের চাল, তাই বৃষ্টির রিমঝিম শব্দে আমার কান্না মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল।

এই বাড়ির চেহারা দ্রুত পালটাতে শুরু করলো। আমাকে ভাঙ্গা হল। শহরে মালিকের একটা জায়গা ছিল অইখানে আমাকে প্রতিস্থাপন করা হল। আমার নতুন জীবন শুরু হল। মফস্বল শহরে। আগে যেহেতু গ্রামে বড় জায়গা নিয়ে থাকতাম, আর অনেক গাছ গাছালী ছিল, তাই প্রথম প্রথম মন টা কাদত। পরে আমার মাল্কিন এর মন এর অবস্থা পরযবেক্ষন করে নিজেকে সামাল দিয়েছি।

এখন আমি শহরের রাস্তার মানুষ দেখি, রিকশা দেখি। ভালই লাগে আস্তে আস্তে নিজেকে এই পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছি। আমার মালকিন খুব কর্মঠ মানুষ। মালিক চলে যাবার পর একা একা পুরো পরিবার পরিচালনা করছেন। একাই। অপরিসীম ধৈর্য আর কর্মশক্তি তাঁর। আমি তার সুখের দিন দেখেছি, এখন তার সংগ্রাম দেখছি। ছেলেমেয়েরা যখন রাতে ঘুমায় … নিঃশব্দে তিনি কাঁদেন। তার সেই কান্নার একমাত্র সাক্ষী আমি। এই দোতালা কাঠের ঘর আমি।

তার সাথে আমিও কেঁদেছি। টিন বেয়ে আমার সেই কান্নার জল তার গায়ে পড়লে তিনি ভেবেছেন গরমে টিন ঘেমে গেছে!!

একে একে ছেলেমেয়ে দের মানুষ হয়েছে, ভাল রেসাল্ট, খেলাধুলায় পারদর্শিতা, আর আচার ব্যাবহারে তার ছেলে-মেয়েরা প্রথম সারিতে। আমার মালকিন, আমার মা এর কষ্ট সার্থক। আনন্দে কেদেছি বহুবার !

ছেলে মেয়ে রা অনেকে আরও বড় শহরে চলে গেল। উচ্চশিক্ষা র জন্য। মা একা হতে থাকল। আমি আর মা অপেক্ষা করতাম অদের বাড়ি ফিরে আসার।
আমরা দু’জনে আস্তে আস্তে বুড়ো হতে থাকলাম!

সবার বিয়ে হল। সবাই প্রতিষ্ঠিত হোল। মা তার ছেলেমেয়ে দের কাছে বড় শহরে যান কিছুদিন থাকেন। আবার আমার কাছে এই ঘর এ আসেন।
এরপর এলো আমার আবার সেই পুরনো জায়গায় প্রত্যাবরতন এর সময় !

শুনতে পেলাম এইখানে দালান হবে। আর আমাকে ফিরিয়ে নেয়া হবে সেই আমার জন্মস্থানে ! বিশ্বাস করেন আমি একটুও দুঃখ পাইনি। আমার মন খুশিতে ভরে উঠেছে। আমি ফেরত এলাম বহু বছর পর আমার সেই আপন আপন গন্ধ ভরা আমার গ্রাম এ। গাছ গাছালী রা আমায় দেখে কি যে খুশি!!
তবে এবার শুধু আমি একাই এলাম। ওরা সবাই শহরের বাসিন্দা। কিভাবে আসবে! চাইলেই কি আর মানুষ জায়গা পাল্টা তে পারে! আমি এখন একা থাকি আর কিছু পোকামাকড় থাকে আমার সাথে। ওরা বছরে এক দু বার আমায় দেখতে আসে!

আমার কি যে ভালো লাগে!

যখন ওরা আবার চলে যায়, আমি কিন্তু কাঁদি আর ওরা ভাবে টিন গড়িয়ে দু ফোঁটা শিশির গড়িয়ে পড়লো বুঝি!!!!!!

এসআইএইচ/বিআই/১৫ আগস্ট, ২০১৬

About মাসুমা রুনা