প্রচ্ছদ / লেখালেখি / অণুকথা / নববর্ষ ও প্রত্যাশার বাংলাদেশ

নববর্ষ ও প্রত্যাশার বাংলাদেশ

• অমিত রায় চৌধুরী

বর্ষবরণ সভ্য সংস্কৃতির স্বাভাবিক অনুষঙ্গ। নানা দেশে নানা বেশে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর রীতি আছে। প্রতিটি উদযাপনের ভঙ্গিতে নিজস্বতা থাকে, থাকে চর্চাভেদে বৈচিত্র্য। উৎসবের নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় বিভিন্ন জাতিসত্তার স্বকীয় বৈশিষ্ট্য প্রতিফলিত। ঐতিহ্যকে ধারণ করেই সময় এগিয়ে চলে, বিবর্তনের ধারায় মননের পরিশীলন ঘটে, অমোঘ সত্য ও ধ্রুপদি সুন্দরের বহমান কালস্রোত শাশ্বত সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে আর মানবসভ্যতা পরিণত হয় বিবিধতার সঙ্গমে।

অখন্ড সময় ভাবনার গর্ভেই কালের চলমানতা। প্রকৃতির ঋতু নির্ভর আবর্তিত রূপ ও বৈশিষ্ট্য ভেদে সময়ের বিভাজিত খেয়া বেয়েই আমরা আজ আরও একটি নতুন বছরের আঙ্গিনায় উপনীত। নতুনের প্রতি বাঙ্গালির আকর্ষণ দুর্নিবার, প্রেম শাশ্বত। সেটাই বাঙ্গালির চিরায়ত প্রকৃতি। আর বিমূর্ত প্রকৃতি চেতনার মাঝেই বাঙ্গালির উত্তুঙ্গ বাঙ্গালিয়ানা, বাঙ্গালি হয়ে ওঠা।

বাঙ্গালি আবেগ প্রবণ, উৎসব মুখিন, অতিথি পরায়ন। এ জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা, জাতীয়তাবোধ ও সংবেদনশীলতা কালের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। গাঙ্গেয় সমতলভূমিতে বসবাসকারী প্রায় ৪ হাজার বছরের পুরনো এ নৃ-গোষ্ঠীর জীবনচর্যা, অর্থনীতি, ধর্মাচরণ-যে কোন মানদন্ডে উদার, মানবিক ও শিল্পমন্ডিত। একটি মিশ্র নৃতাত্ত্বিক উত্তরাধিকার বহন করেও বাঙ্গালির আবহমান মাঙ্গলিক চেতনা, সূক্ষ্ম জীবনবোধ, রুচির আভিজাত্য এবং অসাম্প্রদায়িক চরিত্র বাঙ্গালি জাতিসত্তায় এক দুর্লভ মাত্রা সংযোজন করেছে।

বাঙ্গালি পৃথিবীর একটি অন্যতম বৃহৎ জাতীয়তাবাদী চেতনায় ঋদ্ধ, মর্যাদাশীল জাতিগোষ্ঠী। ভাষা আন্দোলন থেকে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ, অহিংস জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের নিয়মতান্ত্রিক পথ ধরে সশস্ত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমে একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথনকশা বিশ্বের যে কোন নিপীড়িত মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর রোল মডেল। আর তার রয়েছে একটি সুদৃঢ় দার্শনিক ভিত্তি। এদেশের স্বাধীনতার ইতিহাস চেতনা নির্ভর। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বাঙ্গালির হাজার বছরের স্বপ্নের মানচিত্র, একটি বিকাশমান জাতির সম্মিলিত প্রত্যাশার দলিল, বঞ্চনা থেকে মুক্তির সনদ। যেখানে এ ভূ-খন্ডের মানুষের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প, সাহিত্য-সব কিছুই সংযুক্ত।

মহাকালের বিশালত্ব বিবেচনায় মানব জীবনের ব্যপ্তি খুবই নগণ্য। এই সংক্ষিপ্ত সময়কে, যাপিত জীবনকে উপভোগ্য, পরিশীলিত ও অর্থবহ করে তোলার জন্য সৃষ্টির সেরা মানুষের প্রয়াস ক্লান্তিহীন, নিরলস। উৎসব এমনই একটি অনুপম উপকরণ যা মানুষের নির্জীব প্রাণে জলসিঞ্চন করে, অবসন্ন মনকে প্রফুল্ল করে। উৎসবের মধ্যেই একতার সুর, মিলনের অনু-পরমাণু। জীবন যত কর্মমুখর হচ্ছে, যন্ত্রের দাপট হচ্ছে প্রবল থেকে প্রবলতর, ব্যক্তি জীবনের পরিসর যত সংকীর্ণ হয়, ব্যক্তি হতে ব্যক্তির বিচ্ছিন্নতা ততই প্রকট হয়ে পড়ে। ব্যক্তি মানুষ তখন সমষ্টির মাঝে একতার সান্নিধ্যে শক্তির মাহাত্ম অনুভব করে, অভিন্ন ধারায় বিলীন হওয়ার আকাঙ্খায় নিঃষঙ্গ মন মুক্তির আনন্দে নির্ভার হতে চায়, বৃহতের সংগে সংযুক্তির অভিলাষে সে সমর্পিত হতে চায় বাঙ্গালির মূল স্রোতে, বিশাখার দ্যূতিধন্য বৈশাখের প্রথম প্রহরে।

হাজার বছরের বাঙ্গালির সাংস্কৃতিক জীবন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যই হলো উৎসবময়তা। এ ভূ-রাজনৈতিক সীমায় আবদ্ধ শাসকগোষ্ঠীর রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও প্রশাসনিক প্রয়োজনে ব্যবস্থাপনাকে কার্যকর, গতিশীল ও কাঠামোবদ্ধ করার প্রয়াসে চান্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার ব্যবহার লক্ষ্যণীয়। পৌরানিক কাল হতে সম্রাট আকবর হয়ে বাংলা অ্যাকাডেমি অবধি নানা সংস্কারের মধ্য দিয়ে বিমুর্ত সময়ের ধারণা বিবর্তিত হয়েছে। কালের যাত্রাপথে চান্দ্র পঞ্জিকা থেকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তর এবং সমকালীন চাহিদা অনুযায়ী বাংলা পঞ্জিকার পরিমার্জন সম্পন্ন হয়েছে।

কৃষি, অর্থনীতি, বাণিজ্য, শিল্প, স্বাস্থ্য, শিক্ষা-সব খানেই সময়ের এই জ্ঞানভিত্তিক বিভাজনের নির্বিকল্প আবশ্যিকতা প্রমাণিত, প্রতিষ্ঠিত। তাই ধর্মীয় উৎসবের পাশাপাশি নবান্ন, বর্ষাবরণ, পৌষ উৎসব, বসন্তবরণ, চৈত্র সংক্রান্তির মত ঋতুধর্মী সামাজিক উদ্যাপন বাঙ্গালির সর্বাত্মক, সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। এ সব চিরায়ত লোক সংস্কৃতির অংশ কালের পরিক্রমায় একটি স্থানিক ও কালিক বৈশিষ্ট্যে অনন্য হয়ে উঠেছে।

সংস্কৃতি কৃত্রিমভাবে আরোপযোগ্য নয়। জোর করে কিছু আরোপ করলে সভ্যতা তাকে রুখে দেয়। সভ্যতার সুদীর্ঘ ইতিহাস তাই বলে। পাকিস্তানের আধিপাত্যবাদী সামন্তশ্রেণি কায়েমী স্বার্থে ’৫২তে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালিয়ে পক্ষান্তরে বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলনের ভ্রুণ সঞ্চার করেছিল। এরপর রবীন্দ্র চর্চার ওপর নিষেধাজ্ঞা স্বায়ত্ব শাসনের দাবীকে বেগবান করেছে, ’৬৫ তে ছায়নট রমনা বটমূলে বর্ষবরণের মধ্য দিয়ে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের অঙ্কুরিত ভ্রুণের পরিচর্যা করেছে, ’৭১ -এ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক মুক্তি। ’৭২-এ বর্ষবরণ জাতীয় দিবসের মর্যাদা লাভ করে, ’৮৯ সালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে শক্তি যুগিয়েছে নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা। বাংলা সংস্কৃতির অন্তর্গত সামর্থ ও সৌন্দর্য রাষ্ট্রীয় পরিধি টপকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে বিস্তৃত হয়েছে। আধুনিকতার সাথে লোকজ কৃষ্টির মেলবন্ধন বাঙ্গালি সংস্কৃতিকে বিশ্বমানে পৌঁছে দিয়েছে।

সকল বাধা বিপত্তি পেরিয়ে এ প্রজন্মের একজন বাঙ্গালিকে বৈশাখ যা শেখায় তা হলো সংগ্রামের দীক্ষা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের, অশুভের বিরুদ্ধে শুভের জয়রথ চালনার সংকল্প। বাঙ্গালির বর্ষবরণ তার নিজস্ব আঙ্গিকে বাঁধা। ভাবনার সংকীর্ণতা আমাদের চেতনাকে কলুষিত করে, ধারণার অসহিষ্ণুতা আমাদের বিভক্তির পথে চালিত করে। সমাজের বিভিন্ন অঙ্গে যখন ন্যায়ভ্রষ্টতার আধিপত্য, চিরকালীন সামাজিক মূল্যবোধ যখন আক্রান্ত, বাঙ্গালি সংস্কৃতির শুস্ক প্রায় ধারাটিকে প্রাণসঞ্চার করে সজীব করে তোলার তাড়নাকে তখন ভীষণ প্রাসঙ্গিক মনে হয়, প্রয়োজন দেখা দেয় বাঙ্গালির চিরকালীন সাংস্কৃতিক মননকে বিকশিত করার। কেবল উন্নত দেশের অভিজাত বলয়ে প্রবেশগম্যতা নয়, নিছক বৈষয়িক সমৃদ্ধি নয়, দরকার বুদ্ধিবৃত্তিক দারিদ্র থেকে মুক্তি, বিভ্রান্তি-বিকৃতির ধোঁয়াশা নয়, দরকার একটি উদার, মানবিক, ন্যায়ানুগ, উন্মুক্ত সমাজ গঠনের উর্বর ক্ষেত্র। ধর্ম পোশাকে নয়, বিশ্বাসে, মননে। রাজনীতি মঞ্চে নয়, আচারে, মগজে। শুধু নিজে নয়, অন্যকে নিয়ে বাঁচার সংকল্পই হোক আগামী দিনে পথ চলার শক্তি।

ভরসা রাখতে চাই এবারের বর্ষবরণ উৎসবে বাঙ্গালি আবার ফিরে যাবে তার শিকড়ের দিকে, মাটির টানে, মেতে উঠবে লোকায়ত নাচ, গান, যাত্রাপালা, মেলা, নৌকা বাইচ, কবি গান আরও কত অজানা নির্দোষ সংস্কৃতি চর্চায়। বাণিজ্য বিতানে ‘ হালখাতা’ অনুষ্ঠানে শুধু লেনদেনের হিসাব নয়, আত্ম অনুসন্ধানের পাতাটিও উল্টাতে হবে আমাদের চারপাশে-শাব্দিক অর্থেই শুদ্ধাচার স্থাপনের দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়।

পুরাতনের স্মৃতিচিহ্ন বয়ে নিয়ে প্রতিটি নূতনই ভেসে চলে অনন্তের পথে। সে চিহ্ন কখনও প্রবল, কখনও প্রচ্ছন্ন। নতুনের মাঝে পুরাতনের, বর্তমান বা ভবিষ্যতের মাঝে অতীতের উপস্থিতি অমোঘ। জীর্ণ, ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, মলিন যা কিছু- সব ভুলে নতুনের যাত্রা হোক শুরু। বাংলার সংস্কৃতি, ভাষা, ঐতিহ্য বেঁচে থাক চিরকাল; বিদ্বেষ, হানাহানি, বিচ্যুতিমুক্ত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণই হোক নববর্ষের শপথ। নতুন বছর ভালো কাটুক, সমৃদ্ধির পথে আরও এগোক মানবজাতি।

অমিত রায় চৌধুরী: অধ্যক্ষ, ফকিরহাট ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, বাগেরহাট।
E-mail: principalffmmc@gmail.com

এসআইএইচ/বিআই/১৪ এপ্রিল ২০১৮

About অমিত রায় চৌধুরী