প্রচ্ছদ / লেখালেখি / মুক্তবাক / ভালো থাক আমাদের প্রিয় ভৈরব

ভালো থাক আমাদের প্রিয় ভৈরব

• ইনজামামুল হক

river-doratana১.
জনশ্রুতি আছে, বহু আগে থেকেই ভৈরব নদের বাঁকে হাট (বাজার) বসত। নদীর বাঁকে বসা এই হাটের নাম হয় এক সময় “বাঁকের হাট”। কালের বিবর্তনে সেই বাঁকের হাট থেকেই আজকের বাগেরহাট নাম করন।

অবশ্য ‘বাগেরহাট’ নাম করণের আরও কয়েকটি ভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে ঐতিহাসিকদের। তবে জনশ্রুতির মতো বাগেরহাট নামটির সাথে ভৈরব নদীর সম্পর্ক বেশ গভীর। ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগসহ জেলার ঐতিহাসিক ভিত্তিও এই ভৈরব।

পঞ্চদশ শতকে প্রাচীন ভৈরব নদের তীরে ‘খলিফাতাবাদ’ নগর রাষ্ট গড়ে তোলেন হয়রত খানজাহান (রহ:)। নির্মাণ করে ষাটগম্বুজসহ ছোট-বড় শতাধিক মসজিদ ও অনান্য স্থাপনা। খান-উল-আজম উলুঘ খান-ই-জাহানের (খান জাহান নামে বেশি পরিচিত) সময়কার সেই সকল স্থাপনা বর্তমান বাগেরহাট নিয়েছে ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহরে’র স্বকৃতি। যা ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব সংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।

কেবলই ইতিহাস নয়। বাগেরহাট শহর গোড়ে ওঠা; এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগসহ অনান্য ক্ষেত্রেও যতটুকু সমৃদ্ধি তার সাঙ্গে মিশে আছে ভৈরব নদটি।

ভৈরবের বুক থেকে বাগেরহাট শহর।
ভৈরবের বুক থেকে বাগেরহাট শহর।

২.
নদীকে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিশ্বের সব সভ্যতা, সকল ইতিহাসের ভিত্তি। ভিত্তি মানে ভিত (Foundation), ভিত্তি মানে বীজ; যেখান থেকে শুরু বিস্তৃতি, বেড়ে ওঠার গল্পটা।

সেই হিসেবে এই শহরের বেড়ে ওঠার বেড়ে ওঠার গল্পটাও শুরু ভৈরব নদকে ঘিরেই।

তবে কেমন আছে আজ ভৈরব? মৃত প্রায়! আচ্ছা, এটাকে কি মৃত প্রায় বলা উচিত? নাকি, নিত্য হত্যার চেষ্টা।

ভৈরব যেন আজ এই শহরের উচ্ছিষ্ট। তাই শহরের সব উচ্ছিষ্ট, জনজাল, ময়লা আবর্জনা দিয়ে বর্জের ভাগাড় তৈরিতে মরিয়া আমরা সবাই। ভোরের সূর্যদয় বা গধূলীর মায়াবী সৈন্দর্য এখন আর সেই ভাবে ঐশর্য ছড়ায় কি ভৈরব তীরে?

শহর রক্ষায়, জোয়ারের প্লাবন থেকে বাগেরহাটবাসীকে স্বস্তি দিয়ে এক সময় ভৈরব তীরে যে বাঁধ নির্মাণ হয়েছিলো মানুষের মুখে তার (বাঁধ ও রাস্তা) নাম পায় শহর রক্ষা বাঁধ। এক পাশে ভৈরব নদ অন্য পাশে এই নদের আশির্বাদ পুষ্ট শহর। শহর রক্ষা বাঁধ ধরে চলতে থাকলে মনোরম প্রাকৃতি দৃষ্টটা মুগ্ধ করার কথা ছিলো সবাইকে।

শরৎ সুভ্র সাদা মেঘের ভ্যালায় আকাশ জলের লুটো পুটি দেখার কথা ছিলো যেই রস্তায়, ঋতু ঋতুতে নতুন রুপে দেখার কথা ছিলো প্রিয় ভৈরব নদকে – সেখান থেকে এখন চলতে হয় নাক চেপে। বর্জের উটকো গন্ধে দৌড়ে পালাতে হয় পথ শেষ করতে।

Bagerhat-Pic-01(29-06-2016)Dust-Dumping-voyrob-Voirob-riverমাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে দুই দুটি ব্রিজ। নদীর গতিপথ, স্রোতকে থামিয়ে দিয়েছে বহু খানি। দু’পাশ দিয়ে দখলের আগ্রামী গ্রাস। সেই সঙ্গে যেন বর্জ শোধনাগারও ভেবে নিয়েছি আমরা। শিল্পবর্জ বা গৃহস্থ, তরল বর্জ বা কঠিন। সব ফেলনির গন্তবই এখন এই নদ।

স্তুপ স্তুপ ময়লা আবর্জনা দিয়ে দুষণ আর দখলের উৎসবটা চলছে একই সঙ্গে। শহরের সব ড্রেনের ময়লা পানির গন্তব্যও একই।

যে নদ দিয়েছে এই শহরের ভিত, জনপদের সমৃদ্ধি, যাকে ঘিরে আজকের বাগেরহাট। দুষণ, দখলে আজ তাকেই গলা টিপে হত্যার চেষ্টা! যে চেষ্টায় সামিল আমরা সবাই।

৩.
অনেকের মুখে বলতে শুনি, নদী মরে গেছে; আগে এখানে বড় বড় লঞ্চ চলতো, জেলেদের জালে মিলত প্রচুর মাছ। মিলত রুপালী ইলিশ। তবে কোথায় আজ সেই সমৃদ্ধ ভৈরব? কোথায় সেই নদের জৌলস? কোথায় হারালো সে সব?

নদী কি মরেছে? না আমরা নিত্য দিন মেরে ফেলছি তিলে তিলে।

এটা ঠিক, ফ্রি-তে পেলে মর্মটা বেশির ভাগ সময় কমই হয়। তাই বলে কি এমন! যেমনটা করছি আমরা ভৈরবের সঙ্গে।

Bagerhat-Pic-02(29-06-2016)Dust-Dumping-voyrob-Voirob-riverদূষণ-দখল বাড়ছেই: সংকটে ভৈরব নদ

যে ভৈরব আমাদের গর্ব হবার কথা ছিলো নদী তীরের দূরগন্ধ সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তা আজ আমাদের হতাশা। বাড়াচ্ছে শঙ্কা।

নিত্য দখল আর দুষণে এই উৎসব আর কত দিন? নাকি এভাবে চলবে…!

৪.
সময় এসেছে, নাকটা ছাড়ার। কারণ এই দূগন্ধের ভয়ে এভাবে নাক ধরে চলতে.. চলতে… একদিন হয়তো দমটাই বন্ধ হয়ে যাবে।

 এক ঘন্টার বৃষ্টিতে যখন চারপাশ ডুবে যায় তখন হয়তো একটু আট্টু হুশ আসে। কিন্তু তা তো ক্ষণিক। জমে থাকা পানির মতোই; স্থায়ী হয় না।

তবে কি, গলা পানির অপেক্ষা; তার পর ভাববো আমরা। যখন ভাবার জায়গা টাও আর থাকবে না। নাকি নাক ছেড়ে কানটা ধরব এখণ। শুধরাব এখন।

মনে হয় এখনও সময় আছে ভাববার। কিন্তু কাল নাও পারে। তাই আজই ভাবুণ, এখনই। কারণ মৃত্যু যখন হত্যাকান্ড তখন প্রতিশোধের প্রশ্নটাও থেকেই যায়!

Bagerhat-Voirob-river-Munigong৫.
প্রকৃতির সহ্য ক্ষমতা নাকি অসিম, যেমনি ধ্বংসের ক্ষমতাটা। তবে যদি জবর দখলের জবাব দেয় প্রকৃতিও। তবে!

তাই কেবল ভেবেই সময় পার কারে দেবার দিন কিন্তু শেষ। এখনই সময় এগিয়ে আসার। এগিয়ে আসতে হবে আপনাকে, আমাকে, সবাইকে। কেবল মুখের বলি নিয়ে নয়। এই পদক্ষেপ হতে হবে বিশ্বার আর ভালোবাসার।

আমাদের ইতিহাস, আমাদের ঐতিহ্যের বাহক হয়ে, আমাদের এগিয়ে যাবার প্রেরণা হয়ে, আমাদের গর্ব হয়ে বেঁচে থাক ভৈরব। ভালো থাক আমাদের প্রিয় ভৈরব নদ।

লেখক: সংবাদকর্মী ও অ্যাক্টিভিস্ট।
স্বত্ব ও দায় লেখকের…
এসআইএইচ/বিআই/২৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৬

About Inzamamul Haque