প্রচ্ছদ / লেখালেখি / দিনপঞ্জি / শরতের ক্যানভাসে উৎসবের আলপনা

শরতের ক্যানভাসে উৎসবের আলপনা

• অমিত রায় চৌধুরী

কালের নিয়মে শরৎ এলেই বাঙালি মননে রঙের ছোঁয়া লাগে, চেতনা প্রলম্বিত হয়ে ওঠে। প্রকৃতি, পারিপার্শ্বিক ও জীবন—সর্বত্রই মোহনীয় এক রূপান্তর উৎসবের নান্দনিক পরিসরকে রূপে-রঙে বর্ণময়, প্রশস্ত ও উচ্ছল করে তোলে। দেবী আবাহনে উন্মুখ হয়ে ওঠে ভক্তিসিক্ত, আপ্লুত বাঙালির অন্তর্লোক। মানুষে মানুষে নির্লেপ সম্প্রীতির নিখুঁত বুননে রচিত হয় শারদোৎসবের সামাজিক ও মনোজাগতিক বেদিমূল; যা চিরায়ত মানবিকতা, আধুনিকতা ও সর্বজনীনতায় কালোত্তীর্ণ; রুচি ও শিল্পের মাধুর্যে অনন্য।

প্রাচীন এ জনপদে দুর্গাপূজা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে হয়ে আসছে। মাতৃতান্ত্রিক সভ্যতার নৃতাত্ত্বিক পরম্পরাকে ধারণ করে সৃষ্টির আদি কারণ আদ্যাশক্তি, জগজ্জননী, দুর্গতিনাশিনী দুর্গা আরাধনার স্বরূপ ও প্রকৃতি বিবর্তিত মহাকালের ধারায় ক্রমাগত বদলে যাচ্ছে। কালের পরিক্রমায় বৈদিক, পৌরাণিক, ঔপনিবেশিক, সামন্ততান্ত্রিক কিংবা আধুনিক—সব যুগই তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে দেবী বন্দনার রীতি, অঙ্গসজ্জা, ভক্তির অর্ঘ্য, সংকল্প কিংবা বিষয়নির্ভর চিত্রকল্প নির্মাণ করেছে, যা সমকালীন বিষয়ের প্রাসঙ্গিকতায় সারগর্ভ।

বিরুপ প্রকৃতির আগ্রাসন মোকাবেলা বা অতিপ্রাকৃত দূর্বিপাক থেকে মুক্তির আকাঙ্খা কিংবা ইহজাগতিক সমৃদ্ধি অথবা বিশ্বজনীন কল্যাণ কামনা- যে অভিপ্রায়েই মাতৃচরণে এমন উদ্বেলিত বন্দনা হোক না কেন-বিপুলা প্রকৃতিই তার রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ উজাড় করে উৎসবের এক প্রমুর্ত পটভূমি প্রস্তুত করে দেয়।

শরতের নীলাকাশে পরিযায়ী মেঘমালার খেয়ালি বিচরণ, শুচিশুভ্র কাশবনে ছন্দিত স্পন্দন, মহালয়ার পুণ্য প্রত্যুষে সম্মোহনী চণ্ডীপাঠে আবিষ্ট শব্দতরঙ্গ মর্ত্যলোকে আনন্দময়ীর আগমনী বার্তা সূচিত করে, উৎসবপ্রিয় বাঙালি এক অভূতপূর্ব উন্মাদনায় দুর্গোৎসবে মেতে ওঠে। ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ বণিতা যেভাবে এ উৎসবে একাকার হয়ে যায়, গ্রাম থেকে শহর, কুটির থেকে প্রাসদ, নদী থেকে সাগর কীভাবে অনাবিল আনন্দে প্লাবিত হয়ে যায়-তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।

বাংলায় দুর্গাপূজার সাড়ম্বর আয়োজনের সূত্রপাত বোধ হয় ষোড়শ শতকেই। প্রাথমিকভাবে পারিবারিক মন্দিরগুলোতেই এটি সীমাবদ্ধ ছিল, যেখানে ছিল বৈভবের আতিশয্য। ঐতিহ্য, পরম্পরা, শাস্ত্রীয় উত্তরাধিকার অব্যাহত রাখার পাশাপাশি অঢেল বিত্তের প্রদর্শনী ও দুর্গাপূজার অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছিল। লক্ষণীয় যে, জৌলুশময় উৎসবের আঙিনায় সাধারণের প্রবেশ মোটামুটি নিয়ন্ত্রিত ছিল। তবে বৈষম্যহীন সমাজকাঠামো নির্মাণের সংগ্রাম, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় নাগরিকের অংশীদারত্ব প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অনুকূলে প্রবল জনমত সৃষ্টি ও সর্বোপরি দ্রুত পরিবর্তনশীল আর্থসামাজিক বাস্তবতায় সুস্থ, সহিষ্ণু সমাজ বিনির্মাণে নাগরিকের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যে রূপান্তর এনে দেয়, তা-ই হয়তো কালের অমোঘ নিয়মে সর্বজনীন রূপ নেয়। পারিবারিক পূজায় শাস্ত্রীয় লোকাচার ও আধ্যাত্মিকতার আধিপত্য বজায় থাকলেও বারোয়ারি পূজা সর্বাত্মক সামাজিক সম্মিলনীতে রূপ নেয় এবং ক্রমশ তা বাঙ্গালির অন্যতম বৃহত্তম সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়।

শরতের স্নিগ্ধ সুন্দর শিউলি বিছানো গালিচায় শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে দেবীর বোধনের মধ্য দিয়ে দুর্গার জয়োৎসবের সূচনা হয়। মাতৃ আরাধনার পাশাপাশি বাঙ্গালির নিপুণ শিল্পসত্তা, সৃজনশীলতা, সূক্ষ্মজীবনবোধ ও আধুনিকতা অনিন্দ্যসুন্দর ভঙ্গিতে আত্মপ্রকাশ করে।

দেবীর অধিষ্ঠান থেকে বিসর্জন পর্যন্ত, প্রত্যুষ থেকে গভীর রাত অবধি মণ্ডপে মণ্ডপে দর্শনার্থীদের উপচেপড়া ভিড়, প্রযুক্তির কল্যাণে দৃষ্টিনন্দন প্রদর্শনী, আলোর বৃত্তে উদভাসিত ভাবাশ্রয়ী নন্দনশৈলী, অন্তহীন পথচলা, ক্লান্তিহীন প্রতিমা দর্শন, ঢাকের বাজনার সঙ্গে উচ্ছল আরতি, মাইকে ধ্রুপদি বাংলা গানের একটানা সুর— সবই মুগ্ধতার আবেশ তৈরি করে। এককথায় দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি নিবেদন থেকে শুরু করে মণ্ডপের আঙিনায় নির্দোষ আড্ডার নিরীহ আমেজ শুধু উপস্থিত ভক্তবৃন্দকেই না, প্রবাসী বাঙালিকে পর্যন্ত স্মৃতিকাতর করে তোলে। দুর্দান্ত শৈশব ও প্রমত্ত কৈশোরের সেই চঞ্চল অমলিন স্মৃতিখণ্ডগুলো মনের ক্যানভাসে অত্যুজ্জ্বল হয়ে ভেসে ওঠে,  নস্টালজিয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে যায় দূর বহুদূর।

বাঙ্গালি বিশ্বের যেখানেই থাকুক না কেন -আগ্রাসী যন্ত্রসভ্যতার দাপটে তার ক্লান্ত মন খুঁজে পেতে চায় ক্ষণিকের অবসর, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ আর দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের বাংলায় বারবার ফিরে আসতে চায়, জীর্ণ এ স্বপ্ননীড়ে বেঁচে থাকার আকাঙ্খা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়।

আবহমান বাংলা বন্ধনের, মিলনের। চিরকালীন শ্যামলী বাংলা সৌহার্দ্যের, সম্প্রীতির। বাংলার মাটি গাঙ্গেয় পললে পরিপাটি, পবিত্র। বাংলার আকাশ প্রশস্ত, উদার। দেশের অন্যতম বৃহৎ এই সামাজিক সম্মিলন শুধু একটি সম্প্রদায়ের জন্য নয়, যুগ যুগ ধরে জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে দেশের সব নাগরিকের এ উৎসবে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ আমাদের জাতিসত্তার অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের প্রতিফলন ঘটায়। একটি দেশে বসবাসরত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মৌলিক নাগরিক অধিকার ভোগের পরিসর থাকা রাষ্ট্রের সুশাসনের সূচক। একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংকল্প নিয়ে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা একটি আধুনিক, মানবিক জাতিরাষ্ট্র সংখ্যালঘুর আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায় নিশ্চিত করবে-এটিই অভিপ্রেত।

আমাদের প্রত্যাশা,  দেশের সার্বিক অগ্রগতি ও উন্নয়নের ধারায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় সর্বাত্মকভাবে সংযুক্ত হোক, সবার অংশগ্রহণে বাংলার বিরল ঐতিহ্য সর্বজনীন দুর্গোৎসব প্রকৃত অর্থেই হয়ে উঠুক সর্বজনীন—প্রাণবন্ত, সার্থক ও সুন্দর। আর নতুনের বার্তা নিয়ে উৎসবের চিরায়ত ঐশ্বর্যের আলোক ধারা অনন্তের পথে বয়ে চলুক নিরলস, নিরবধি।

লেখক: অধ্যক্ষ, ফকিরহাট ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মহিলা ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়, বাগেরহাট।
E-mail: principalffmmc@gmail.com

এসআইএইচ/বিআই/২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

About অমিত রায় চৌধুরী