প্রচ্ছদ / খবর / রমরমা মাজার ব্যবসা: এক মুরগি শতবার বিক্রি!

রমরমা মাজার ব্যবসা: এক মুরগি শতবার বিক্রি!

Majar-business-2014রোকেয়া বেগম, ছেলে-মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে খুলনা থেকে বাগেরহাট এসেছেন ঐতিহাসিক হযরত খানজাহান (রঃ)এর মাজারে। এক বার ছেলে অসুস্থ হলে মাজারে মুরগি দেয়ার মানত করেছিলেন কোনো একসময়। এখন এসেছেন সে মানত পূরণ করতে।

সন্ধ্যার খানিকটা পর।মাজারে তখন চলছিল বার্ষিক ওরস ও মেলা। মাজারের চারপাশ জুড়ে ভক্ত আর মানুষের ভীড়। রোকেয়া বেগম সে ভীড় ঠেলে মাজারের দীঘিতে এগিয়ে গেলেন। সেখানে থাকা কুমিরের খাদ্য হিসেবে মানতের মুরগি ছেড়ে দিলেন।

ঘড়ির কাটা মেপে সময় মাত্র এক মিনিট। এর মধ্যেই মানতের সে মুরগি কুমিরের পেটে না গিয়ে আটকা পড়লো মানুষের হাতে।

মাজারের দিঘিতে মুরগি ছাড়তে দেখেই ছুটে এসেছিল ১২/১৩ বছরের একটি ছেলে। মুরগিটি পানিতে ফেলতেই হাঁটু পানিতে নেমে মুরগিটিকে ধরে নিয়ে খাঁচায় আটকে রাখলো ছেলেটি।

না ভাববে না এখানেই ঘটনার শেষ। খাঁচার কাছে যেতে চোখে পড়লো খাঁচাতে বেশ কয়েকটি মুরগি আটকে আছে। মুরগিগুলোর শরীরের পানি ঝরতে দেখে বোঝা গেলো বাকি মুরগিগুলোও এমনই দীঘি থেকে ধরে আনা। খাঁচার পাশে বসে আছেন ষাটোর্ধ্ব একজন। পরিচয় জানতে চাইলে নিজেকে মাজারের খাদেম বলে পরিচয় দেন তিনি। কথা বলে জানা যায় তার নাম ফকির মজনু।

Majar-business-2014-(2)মাজারের ঘাটে বসে ফকির মজনু খাঁচার মুরগি বিক্রি করছেন দেদারসে। একদাম ৩’শ টাকায় সে মুরগি কিনে নিচ্ছে অনেকেই। মানত আর দীঘির কুমিরের জন্য ছেড়ে দিচ্ছে দীঘিতে। আবার দীঘি থেকে মুরগি এসে ঢুকছে ফকির মজনুর খাঁচাতেই। মজনু ফকিরের কাছে মানতের নানা জিনিসও জমা হচ্ছে। এরমধ্যে রয়েছে নারকেল, কলাও। তবে, এসব কিছু মাজারের তহবিলে যাচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয় অনেকেই।

প্রায় আড়াইঘণ্টা ধরে মুরগির খাঁচার পাশে দাঁড়িয়ে দেখা গেলো একটি মুরগিই বিক্রি হচ্ছে বারবার।

প্রত্যক্ষদর্শী হাবিবুর রহমান বলেন, ‘সকাল থেকেই এ তামশা দেখছি। একটা মুরগি একশোবার বিক্রি করা হয়েছে।’

দীঘিতে মানতের মুরগি ফেলেছেন রফিক নামের একজন। তার মুরগিও চলে গেছে খাদেমের খাঁচায়। বিষয়টি সম্পর্কে খাদেমের কাছে জানতে চাইলে রীতিমতো অপমানিতও হতে হয়েছে তাকে।

Majar-business-2014-(3)রফিক অভিযোগ করে বলেন, ‘এমন জানলে এখানে মানতের মুরগি ফেলতাম না। তবে আমার কাজ আমি করেছি, যারা এ মুরগি খাবে তারা সেটার জবাব দেবে।’

এদিকে দীঘিতে মুরগি ধরার জন্য ঘাটের কাছে একটা নৌকাও দেখা গেছে। দু’জন সে নৌকা দিয়ে ঘুরে ঘুরে দীঘিতে ছাড়া মুরগি ধরার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে সুনিপুনভাবে। কোনো মুরগিই তাদের হাতছাড়া হচ্ছে না, ধরা পড়ে যাচ্ছে কৌশলে।

মানুষের মানত করা মুরগি ধরে এনে বারবার বিক্রি করা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খাদেম মজনু ফকির বাগেরহাট ইনফো ডটকমের কাছে এটা তার দায়িত্ব বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, ‘এখানে মুরগি ফেললে কুমির খায় না। মরে গিয়ে সে মুরগি দুর্গন্ধ ছড়ায়। সেজন্য আমরা মুরগি তুলে আনছি।’

এক মুরগি বারবার বিক্রি করার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এমনটি করা অন্যায় না। মুরগি বিক্রির এ টাকা মাজারের ফান্ডেই জমা হচ্ছে।’ তবে এসময় মুরগি বিক্রির কোনো রশিদ দেখাতে পারেননি তিনি।

এ পর্যায়ে খাদেম মজনু কিছুটা উত্তেজিত হয়ে দম্ভের সাথে বলেন, ‘এখানে আমরা চারশ খাদেম আছি। আমরা সবাই খানজাহান আলীর বংশধর। এখানে আসা মানত, সদকাসহ সব ধরনের টাকার ৬০ ভাগ আমরাই ভোগ করি। বাকিটা মাজারের উন্নয়নে ব্যয় হয়।’

তবে তাদের কাথা অনুযাই উন্নয়নের নমুনাও কিন্তু দেখা মিলেছে, বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ মাজার ভবনটি তারা সকল প্রকার নিয়ম নীতিকে বৃদ্ধা অঙ্গুল দেখিয়ে ইচ্ছা স্বাধীন ভাবে তার করেছে চুনকাম। নষ্ট করেছে তার স্বকিয়তা।

Majar-business-2014পুরো বিষয়টি সম্পর্কে মাজারের প্রধান খাদেমদের একজন শের ফকিরের সঙ্গে কথা বললে বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে তিনি বলেন, ‘এ পুকুরসহ (দিঘি) পুরো মাজারের দেখভালের দায়িত্ব আমাদের। গণহারে পুকুরে মুরগি ফেললে সেগুলো মরে যায়। পরে আর কুমির সে মুরগী খায় না। তাই সেগুলো ধরে রেখে পরে সময় মতো কুমিরের খাবার হিসেবে দেয়া হয়। তবে এক মুরগি বারবার বিক্রি করার কোনো খবর আমি জানি না।’

আর মাজার ভবনে রং (চুন এবং সাদা সিমেন্টের প্রলেপ) কারার বিষয়ে জানতে চাইলে প্রত্নতত্ব অধিদপ্তরের উপর দায় চাপিয়ে বাগেরহাট ইনফোকে তিনি বলেন, লবনের কারণে মাজার ভবনটি নষ্ট হচ্ছিল। সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগ কোন পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাধ্য হয়ে তারা চুনকাম চুন এবং সাদা সিমেন্টের প্রলেপ) করেছে।

প্রত্নসম্পদে বিশ্ব ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ঐতিহাসিক জেলা বাগেরহাট। ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ্-এর রাজত্বকালে খান উল আজম উলুঘ খান-ই-জাহান পদবিধারী একজন মুসলিম সেনানায়ক এ অঞ্চলে ‘খালিফাতাবাদ’ নামে একটি শহরের প্রতিষ্ঠা করেন।

তার কবরে উত্কীর্ণ শিলালিপি থেকে জানা গেছে, তার মৃত্যু ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দে। খান উল আজম পদবিধারী ওই সেনানায়ক তার শহরে দরবার হল (ষাটগম্বুজ মসজিদ), মসজিদ, আবাসিক ভবন, রাস্তাঘাট দ্বারা সুসজ্জিত করেছিলেন।

এলাকার মানুষের সুপ্যেয় পানির জন্য ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে খানজাহান আলী (রা.) খাঞ্জেলী দীঘি নামে একটি বিশাল দীঘি খনন করান। যা এখনও খানজাহান আলী দীঘি নামে পরিচিত।

৩৬০ বিঘা আয়তনের বিশাল এই দীঘিতে হযরত খানজাহান (র:) এর দুটি পালিত কুমির ছিল। কীভাবে ওই কুমির দীঘিতে এসেছে তার সঠিক ইতিহাস জানা যায়নি।

এই কুমির নিয়ে রয়েছে নানান জনশ্রুতি। একটি জনশ্রুতি হলো হযরত খানজাহান আলীর দুটি ঘোড়া অলৌকিকভাবে কুমিরে পরিণত হয়েছে। তার একটি ‘কালা পাহাড়’ অপরটি ‘ধলা পাহাড়’।

অপর একটি জনশ্রুতি রয়েছে, হযরত খানজাহান আলী দু’টি দুষ্ট জ্বিনকে কুমির বানিয়ে দীঘিতে ছেড়ে দিয়েছিলেন। অপর একটি জনশ্রুতি রয়েছে, সুপ্যেয় পানির জন্য খনন করা দীঘির পানি যাতে কেউ অপবিত্র করতে না পারে সেজন্য নদী থেকে দুটি কুমির ধরে এনে দীঘিতে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। কেউ কেউ বলছেন, উপকূলীয় এই জেলাতে স্বাভাবিকভাবেই কুমির বাস করে। ওইসব কুমিরই কোনোভাবে দীঘিতে চলে এসেছে।

হযরত খানজাহান (র:) এর পালিত সেই কুমিরগুলো বহুকাল আগেই মারা গেছে। তাদের শেষ বংশধর সর্বশেষ ছিল দু’টি কুমির (মাদি কুমিরটির নাম ছিল ‘ধলা পাহাড়’ আর মদ্দা কুমিরটির নাম ‘কালা পাহাড়’)। তবে এ দু’টি কুমিরও মারা গেছে কয়েক বছর আগে।

কালা পাহাড় বেঁচে থাকতেই সরকারি উদ্যোগে ২০০৫ সাল এর সঙ্গ আরও ৬টি কুমির এনে ছাড়া হয়ে দীঘিতে। এর দুটি মারা গেছে। বর্তমানে বেঁচে আছে চারটি কুমির।

মাজারের খাদেম ও আশপাশের লোকজন জানান, খানজাহান আলীর কুমিরের বংশধর কুমিরগুলো ছিল বেশ শান্ত স্বভাবের। কিন্তু নতুন আনা কুমিরগুলো খুবই হিংস্র। তবে কত কয়েক বছরে কিছুটা শান্ত সভাবের হয়েছে এগুলো।

০৪ এপ্রিল ২০১৪ :: স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট,
বাগেরহাট ইনফো ডটকম।।
এসআই হকনিউজরুম এডিটর/বিআই

About ইনফো ডেস্ক