প্রচ্ছদ / খবর / স্থাপনা নির্মাণে হুমকিতে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ চুনাখোলা মসজিদ

স্থাপনা নির্মাণে হুমকিতে ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ চুনাখোলা মসজিদ

bagerhat-chunakhola-mosque-risk-pic-120-11-2016বাগেরহাট, ইউনেস্কো ঘোষিত ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর’। পঞ্চদশ শতকে ষাটগম্বুজ মসজিদসহ তৎকালীন ‘খলিফতাবাদ’ নগর রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা হযরত খান জাহান (র:) গোড়ে তোলেন প্রাচীন এই শহরটি। যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ম্যাগাজিন ‘ফোর্বস’ প্রকাশিত বিশ্বের হারিয়ে যাওয়া ১৫টি ঐতিহাসিক শহরের একটি এই খলিফতাবাদ।

খান জাহান (র:) নামে পরিচিত ‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’ নির্মিত প্রাচীন এই শহরকে ১৯৮৫ সালে এতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ৩২১ নম্বর ‘বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা-ইউনেস্কো। 

খান জাহানীয় স্থাপত্য শৈলীর অনন্য এসব নির্দশন বাংলাদেশের এক অমূল্য প্রত্নসম্পদ। ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ, বিবি বেগনী মসজিদ, চুনাখোলা মসজিদ, জিন্দাপীর মসজিদ, দরিয়া খাঁ’র মসজিদ, নয়গম্বুজ মসজিদসহ আবিষ্কৃত  খান জাহানের স্থাপত্য নিদর্শনগুলো ইউনেস্কো ঘোষিত দেশের তিনটি ‘বিশ্ব ঐতিহ্যে’র একটি ।

স্টাইলে নির্মিত অনন্য স্থপত্য শৈলীর এসব নির্দশন বাংলাদেশের প্রত্নসম্পদের এক অমূল্য সম্পদ। 

আহাদ হায়দার । বাগেরহাট ইনফো ডটকম

bagerhat-chunakhola-mosque-pic-20-11-2016সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্য, মসজিদের শহর বাগেরহাটের অন্যতম পুরাকীর্তি চুনাখোলা এক গম্বুজ মসজিদের ‘কোর জোনে’র ভেতরে স্থানীয় এক ব্যক্তি পাকা স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেছেন। এতে দৃষ্টিনন্দন সৌন্দর্য ও ঐতিহ্য হারাতে বসেছে ঐতিহাসিক মসজিদটি।




প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বলছে, চুনাখোলা মসজিদের গা ঘেঁষে পশ্চিম দিকে পাকা দালান নির্মাণকারী মো. হান্নান শেখকে তারা নির্মাণকাজ বন্ধের জন্য কয়েক দফা নোটিশ করেছে। কিন্তু তিনি কাজ বন্ধ না করে উল্টো প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ঐ আদেশের বিরুদ্ধে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আদালতে মামলা করেন।

বাগেরহাট সহকারী জজ আদালতে দায়ের করা ওই মামলায় প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বাগেরহাট (ষাটগম্বুজ) জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান এবং সরকার পক্ষে বাগেরহাটের জেলা প্রশাসককে বিবাদী করা হয়েছে।

প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সূত্র জানায়, ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিম দিকে বাগেরহাট সদর উপজেলার কাড়াকাড়া ইউনিয়নের মরগা মৌজায় অবস্থিত চুনাখোলা মসজিদ। মসজিদটি দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ১২ দশমিক ৯ মিটার। 

সুলতানী আমলের স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত মসজিদের দেয়াল ২ দশমিক ৩৬ মিটার প্রশস্ত। ভেতরে পশ্চিম দেওয়ালে সুদৃশ্য পোড়া মাটির কারুকাজ (টেরাকোটা) সজ্জিত দুটি ছোট ও একটি বড় মেহরাব রয়েছে।

অপর তিন দিকে তিনটি প্রবেশদ্বারসহ উত্তর দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি দরজা রয়েছে। বক্র ছাদপ্রান্ত ও বাইরের দেয়ালের চতুর্দিকে সুদৃশ্য পোড়ামাটির আলপনা।

১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ সরকার অমূল্য এ স্থাপনাকে ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি ঘোষণা করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের হাতে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ন্যস্ত করে।

bagerhat-chunakhola-mosque-risk-pic-220-11-2016সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সীমানা প্রাচীরবিহীন মসজিদটির বাইরের মেঝে মগরা বিলের সমতলের রয়েছে। বর্ষা মৌসুমে অধিকাংশ সময় মসজিদের ভেতরে পানি প্রবেশ করেন বলে জানায় স্থানীয়রা। পর্যটকদের যাতায়াতের সুবিধার্থে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ সম্প্রতি পূর্ব দিকে একটি রাস্তা নির্মাণ করছে।

মসজিদের তিন দিকেই আগে পুকুর ছিল। কিছুদিন আগে পশ্চিম দিকে পুকুরের মালিক হান্নান বালু ও মাটি ফেলে জমি উঁচু করেন। সেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা সুরক্ষার জন্য নির্ধারিত এলাকার (কোর জোন) মধ্যেই অর্ধনির্মিত অবস্থায় রয়েছে একটি ইটের পাকা দালানের কাঠামো। স্থাপনা নির্মাণ হচ্ছে চুনাখোলা মসজিদের সামনের অংশেও।

বিশ্ব ঐহিত্যের এই মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই দেশি-বিদেশি পর্যটকরা আসেন এখানে। তবে মসজিদকে ঘিরে পর্যটন শিল্প বিকাশের অফুরন্ত সম্ভাবনা থাকলেও লাগায়ো স্থাপনা নির্মাণে উদ্বিগ্ন তারাও।

শনিবার চুনাখোলা মসজিদের পাশে রস সংগ্রহের জন্য খেজুর গাছ কাটছিলেন মগরা গ্রামের বাসিন্দা মো. মুজিবর রহমান। তিনি জানান, ‘প্রত্নতত্ত্ব থেকে নোটিশ করার পর গ্রামের অনেকেই তাকে (হান্নান শেখ) এ কাজ থেকে সরে আসতে বলেছেন। তবে গ্রামবাসীর কথায় তেমন সাড়া দেননি।’

একই গ্রামের বাসিন্দা আবু মাসুদ শেখ বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে জানান, মানুষের জমির চাহিদা বাড়ছে। আগে বিল থাকলেও এখন অনেকেই নতুন বাড়িঘর নির্মাণ করছেন। মসজিদমুখী রাস্তা নির্মাণ শুরুর পর থেকে এ প্রবণতা বাড়ছে। এমনকি, মসজিদের কিছুটা সামনে আরেক ব্যক্তি ঘর তুলছেন।

এ বিষয়ে ষাট গম্বুজ মসজিদ কমপ্লেক্স ও বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টডিয়ান মো. গোলাম ফেরদৌস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, ‘গত প্রায় এক মাস ধরে আমরা সমস্যাটি নিয়ে ভোগান্তিতে আছি। ১৯৬৮ সালের পুরাকীর্তি আইনের ১২ এর (সি) ধারা অনুযায়ী আব্দুল হান্নানকে কয়েক দফা নোটিশ করা হয়েছে। এই ধারায় পুরাকীর্তির উপরে বা কাছে নির্মাণ কাজের ক্ষেত্রে ভূমি মালিকের অধিকার সীমাবদ্ধ করা হয়েছে।’

bagerhat-chunakhola-mosque-pic-3গোলাম ফেরদৌস বলেন, ‘প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নোটিশ অগ্রাহ্য করে তিনি নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখে। এক পর্যায়ে তিনি আদালতের স্মরণাপন্ন হয়ে বিভ্রান্তিকর অসত্য তথ্য উপস্থাপন করে আমাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা চেয়েছেন। আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা যথাসময়ে আদালতে আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন করবো।’

তিনি জানান, বাগেরহাটের অধিকাংশ ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থলের জমিজমাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আদালতে এক বা একাধিক মামলা চলমান রয়েছে। মামলা গড়িয়েছে উচ্চ আদালতেও।

তালিকাভুক্ত নিদর্শন ও পুরাকীর্তি নিয়ে মামলাগুলো মূলত ভূমি মালিকদের পুরাকীর্তি আইনের লংঘন ও অধিদপ্তরের হস্তক্ষেপের কারণে।

bagerhat-chunakhola-mosque-pic-4স্থাপনা নির্মাণকারী জমি মালিক শেখ আব্দুল হান্নান আদালতে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করেছেন, উত্তারাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিতে বসবাসের জন্য বহু টাকা ব্যয় করে তিনি এই স্থাপনা নির্মাণ করছেন। সরকার প্রয়োজনে এই জমি অধিগ্রহণ করতে পারে, সেটা তখনকার বিষয়। কিন্তু এখন তাকে নিজ জমিতে নির্মাণ কাজে বাঁধা দেয়ার অধিকার প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নেই।

তিনি দাবি করেন যে, চুনাখোলা মসজিদ বিশ্বঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত নয় এবং পুরাকীর্তি হিসেবে এটি গেজেটভুক্তও হয়নি।

গোলাম ফেরদৌস বলেন, চুনাখোলা মসজিদের সৌন্দর্যবর্ধন এবং নিরাপত্তা ও পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে কিছু উন্নয়ন প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন। এর আওতায় মসজিদের চারিদিকে সীমানা প্রাচীরসহ বাফার জোন ও কোর জোন তৈরি হবে। এজন্য জমি অধিগ্রহণ করা হবে। অধিগ্রহণযোগ্য জমি থেকে বাড়তি মুনাফা লাভের আশায় কিছু মানুষ অবৈধভাবে জমির শ্রেণি পরিবর্তন ও স্থাপনা নির্মাণ করছেন।

chunakhola-mosque-bagerhatপ্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর একটি গবেষণা ও সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি মামলা বৃদ্ধির ঘটনায় উদ্বিগ্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। 

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস বাগেরহাট ইনফো ডটকমকে বলেন, পুরাকীর্তিতে সমৃদ্ধ বাগেরহাট ঐতিহাসিক গৌরব উজ্জল একটি জেলা। এই পুরাকীর্তিগুলো আমাদের জাতীয় সম্পদ।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের কাজ থেকে চিঠি পেয়ে জেলা প্রশাসন চুনাখোলা মসজিদের পাশের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ করে দিয়েছে। জেলার অন্যান্য পুরাকীর্তিগুলোও সংরক্ষণে আমরা সচেষ্ট রয়েছি।

এসআইএইচ/বিআই/২৩ নভেম্বর, ২০১৬

About আহাদ হায়দার