প্রচ্ছদ / খবর / শতবর্ষে পদার্পণ: বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজ

শতবর্ষে পদার্পণ: বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজ

চিফ নিউজ এডিটর | বাগেরহাট ইনফো ডটকম

গৌরব ও ঐতিহ্যের ৯৯ বছর পেরিয়ে শতবর্ষে পদার্পণ করল দক্ষিণ অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী বাগেরহাট সরকারি পিসি কলেজ।

শততম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার (৯ আগস্ট) সকালে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও সুধীজনদের নিয়ে কলেজ ক্যাম্পাসে আনন্দ র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়। পরে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের (পিসি রায়) প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

পরে কলেজের প্রতিষ্ঠাতা আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের (পিসি রায়) প্রতিকৃতিতে মাল্যদান ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

কলেজ চত্ত্বরে আচার্য পিসি রায়ের ভাস্কর্যের পাদদেশে অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক অধ্যাপক মাধব চন্দ্র রুদ্র। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক এ এইচ এম এ ছালেক। সভায় পিসি রায়সহ কলেজটি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখা ব্যক্তিদের স্মরণ করা হয়।

১৯১৮ সালের ৯ আগস্ট শহরের হরিণখানা এলাকায় ১২ বিঘা জমির উপর ‘বাগেরহাট কলেজ’ নামে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু করে। ঐ দিনই পিসি রায়ের জিম্মায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

অবশ্য কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ শুরু হয় আরও আগে; ‘অসহযোগ আন্দোলনে’র ঐতিহাসিক সময়ে। ৯০৫ সালে বাগেরহাটের কাড়াপাড়া শরৎচন্দ্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে রসায়ন বিজ্ঞানী কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের উপস্থিতিতে কাড়াপাড়ার তৎকালিন জমিদার প্রসন্ন কুমার ভট্টাচার্য বাগেরহাটে একটি ‘কলেজ প্রতিষ্ঠার’ প্রস্তাব করেন।

তখন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র প্রস্তাবটিতে সম্মতি দিয়ে বাগেরহাটের উন্নয়নে ‘হাবেলি হিতৈষিণী পরিষদ’ গঠন করেন। ওই পরিষদে স্থানীয় শিক্ষানুরাগীরা কলেজ প্রতিষ্ঠায় যোগ দেন। তারা তৎকালিন বাগেরহাট মহকুমা শহরের হরিণখানা এলাকায় কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে স্থানীয় কয়েকজন শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে বিনা পণে (মূল্যে) ১২ বিঘা জমি কলেজের নামে দলিল করে দেন।

১৯১৬ সালে ওই জমিতে গড়ে তোলা হয় গোলপাতার ঘর। তৈরি হয় শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষকদের আবাস। দুই বছর পর ১৯১৮ সালের ৯ আগস্ট ওই গোলপাতার ঘরে ‘বাগেরহাট কলেজ’ নামে যাত্রা শুরু। প্রতিষ্ঠার অল্প কিছু দিনেই কলেজের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।

পিসি রায়ের অনুরোধে কলেজের প্রথম অধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন ঋষি কামাখ্যা চরণ নাগ। প্রায় ২২ বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সে সময়ে গভার্নিং বডির সদস্যদের সাথে দ্বারে দ্বারে ঘুরে অর্থ সংগ্রহ করতেন তিনি।

১৯২৪ খ্রিস্টাব্দ (সাল) পর্যন্ত ইংরেজী, গনিত, ইতিহাস ও সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতক (অনার্স) পড়ানো হতো কলেজটিতে। পরবর্তীতে বাংলা, অর্থনীতি, আরবী ইত্যাদি বিষয়ে স্নাতক খোলা হয়।

১৯৩২ সালের দিকে কলেজের গভর্নিং বডির সিদ্ধান্ত হয় প্রফুল্ল চন্দ্রের নামে কলেজটির নামকরণের জন্য। সেই সময়ে আর্থিক দৈন্যতায় পড়েছিল কলেজটি। তখন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র তার ব্যক্তিগত তহবিল থেকে টাকা দেন।

১৯৩৩ সালে বাগেরহাট মহকুমার তৎকালীন এসডিও বিষ্ণুপদ ভট্টাচার্য কলেজটির গোলপাতার ঘর ভেঙ্গে আধুনিকায়নে হাত দেন। তৈরি করেন নতুন অবকাঠামো। যার মধ্যে ছিল বিজ্ঞান ভবন, ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাস।

১৯৩৫ সালে স্থাপিত হয় জুবিলী ও ডি.বি নামক দুইটি ছাত্রাবাস।

১৯৩৬-৩৭ সালের দিকে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তিনি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পরে ‘বাগেরহাট কলেজ’র নামকরণ করা হয় ‘আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র মহাবিদ্যালয়’।

১৯৭৯ সালের ৭ মে কলেজটি জাতীয়করণ (সরকারি) হয়। ১৯৯৬ সালে ১৪টি বিষয়ে অনার্স ও ৬টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু হয়। বর্তমানে ১৪টি বিষয়ে অনার্স এবং ৯টি বিষয়ে মাস্টার্স কোর্স চালু আছে। বর্তমানে এখানে প্রায় সাড়ে আট হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত।

এই কলেজ থেকে কৃতকার্য হওয়া প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের অনেকেই কবি, রাজনীতিক, মন্ত্রী, সাংসদ, আমলা, চিকিৎসক, শিক্ষক হয়ে দেশ সেবার কাজে নিয়োজিত ছিলেন ও রয়েছেন। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু, কবি মেঘনাদ রায়, শেরেবাংলা একে ফজলুল হক এই কলেজেরই ছাত্র ছিলেন।

১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলন ও একাত্তরের স্বাধীনতাযুদ্ধে এই বিদ্যাপিঠের শিক্ষক ও ছাত্রদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা।

পিসি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বর্তমানে বাগেরহাট-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মীর শওকাত আলী বাদশা বলেন, ‘পিসি রায়ের অমর সৃষ্টি এই বিদ্যাপিঠ। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি আমার প্রাণের প্রতিষ্ঠান। ওই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানে যারা আমার শিক্ষাগুরু ছিলেন তাদের কথা ভোলার নয়। তারা আমাদের সন্তানের মত ভালবেসে শিক্ষা দিতেন। যা এখন ভাবাই যায়না।’

এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্র বর্তমানে বাগেরহাট-৪ আসনের সংসদ সদস্য ডা. মোজাম্মেল হোসেন বলেন, ‘এই প্রজন্মের অধিকাংশই পিসি রায়ের কথা জানেনা। শতবর্ষ পূর্তিতে পিসি রায়ের জীবনী তুলে ধরাসহ নানা অনুষ্ঠানমালা থাকবে।’

পিসি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও শিক্ষক অধ্যাপক বুলবুল কবির বলেন, ‘পিসি রায়ের হাতে গড়া এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আমি ছাত্র থেকে শিক্ষক। যা আমি কোন দিন ভুলতে পারব না।’

সরকারী পিসি কলেজের উপাধ্যাক্ষ অধ্যাপক শেখ মুস্তাহিদুল আলম রবি জানান, পিসি কলেজের প্রাক্তন ছাত্র ও সুধিজনদের নিয়ে শতবর্ষ পূর্তি অনুষ্ঠান উদযাপনে প্রস্তুতি সভা করা হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ বা এপ্রিল মাস নাগাদ শতবর্ষ উদযাপন করার প্রস্তুতি চলছে।

এজি-এইচ//এসআই/বিআই/০৯ আগস্ট, ২০১৭

About অলীপ ঘটক