প্রচ্ছদ / দর্শনীয় স্থান / ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাগেরহাট

ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বাগেরহাট

ইনজামামুল হক । বাগেরহাট ইনফো ডটকম

Sundarban
সুন্দরবন

 ‘‘সুন্দরবনে বাঘের বাস

দড়াটানা ভৈরব পাশ

সবুজে শ্যামলে ভরা,

নদীর বাঁকে বসতো যে হাট

-তার নাম বাগেরহাট।’’

        কবি আবু বকর সিদ্দিকের এই লেখাতেই ফুটে ওঠে ঐতিহাসিক বাগেরহাটের ভৌগোলিক পরিচিতি। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণের উপকূলীয় জেলা বাগেরহাট যা প্রাচীণ সমতটের একটি জনপদ। বাগেরহাট নামটির সাথে মিশে হযরত খান জাহান (রহ:) এর (‘খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান’) স্মৃতিবিজড়িত গৌরবময় কীর্ত। মধ্যযুগে নির্মিত মুসলিম স্থাপত্যের এ নিদর্শন গুলো এখন বিশ্বঐতিহ্যের অংশ।

এ জেলার আর এক বড় অংশ জুড়েই রয়েছে আরেক বিশ্বঐতিহ্য, পৃথিবী বিখ্যাত ম্যানগ্রভ বন সুন্দরবন। করমজল, দুবলারচর, কচিখালীসহ সুন্দরবনের বেশ কয়েকটি পর্যটন স্পট এ জেলার অন্তর্গত। রয়েছে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ দেশের ২য় সমুদ্র বন্দর- মংলা বন্দর। আর পুর জেলাজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিশ্বঐতিহ্যের অংশ অনেক পুরাকীর্তি।

বাগেরহাট জেলার আবস্থান
বাগেরহাট জেলার আবস্থান

খুলনা জেলার দক্ষিণে (২২°- ৩৯¢ উত্তর অক্ষাংশ থেকে ৮৯°- ৪৭¢ দ্রাঘিমাংশ) প্রাচীন ভৈরব নদীর বাঁকে মুসলিম-পূর্বযুগের বসতিস্থলে পঞ্চদশ শতকের প্রথমার্ধে খালিফাতাবাদ নামে গড়ে ওঠা এই জনপদটিই বর্তমানে বাগেরহাট নামে পরিচিত।

বাগেরহাট জেলা তথ্য বাতায়ন সূত্রে জানা যায়, এই জেলায় প্রথম বসতি স্থাপন করেছিল অনার্য শ্রেণীর মানুষ। এদের মধ্যে ছিল ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল থেকে আসা অষ্ট্রিক ও দ্রাবিড় এবং মঙ্গোলীয় আলপাইনরা। এ অঞ্চলে অনার্য প্রভাবের বড় নিদর্শন হলো পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়। এ জেলার বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে রামপাল উপজেলায় এ সম্প্রদায়ের লোক বেশি বাস করে। পৌণ্ড্র শব্দের অপভ্রংশ (বিকৃত রূপ) পুড়া বা পোদ। পৌণ্ড্র শব্দটি দ্রাবিড় শব্দজাত, যার অর্থ ইক্ষু। অনার্য শ্রেণীভুক্ত নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের মানুষও বাগেরহাটে প্রচুর বাস করে। এদের আগের নাম চণ্ডাল।

ইতিহাসবিদদের মতে, তারা বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে এসে এখানে বসবাস শুরু করেন। এছাড়া বাগেরহাটে এক শ্রেণীর মৎস্য শিকারি বা জেলে বসবাস করে, যাদের আদিপুরুষ নিগ্রোবটু (নিগ্রয়েড)। এরা ভারত উপমহাদেশের আদিমতম অধিবাসী। খ্রিস্টের জন্মের প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে মধ্যএশিয়া থেকে এ অঞ্চলে আর্য তথা আদি নর্কিভ বা ইন্ডিভদের আগমন ঘটে। আর্য-অনার্যের শোণিত ধারাই এ অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে। বস্তুপূজারি অনার্যরা কৌমধর্ম (টাইবাল ধর্ম) অনুসরণ করত। শক্তিপূজারি আর্যরা নিয়ে আসে বৈদিক ধর্ম। সূর্য ও অগ্নি ছিল তাদের অন্যতম উপাস্য। আর্য ও অনার্য উভয় ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতির মিশ্রণে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দু ধর্ম।

বাগেরহাটের অতিপ্রাচীন স্থান পানিঘাটে প্রাপ্ত কষ্টিপাথরের অষ্টাদশভুজা দেবীমূর্তি, মরগা খালের তীরে খান জাহান (রহ:)পাথরভর্তি জাহাজ ভেড়ার স্থান জাহাজঘাটায় মাটিতে গ্রোথিত পাথরে উত্কীর্ণ অষ্টাদশভুজা মহিষ মর্দিনী দেবীমূর্তি, চিতলমারী উপজেলাধীন খরমখালি গ্রামে পাওয়া কৃষ্ণপ্রস্তরের বিষ্ণুমূর্তি ইত্যাদি নিদর্শন এখানে হিন্দু সভ্যতার পরিচয় বহন করে। ১৪৫০ খ্রিস্টাব্দে খান জাহান (র:) খাঞ্জেলি দীঘি (খান জাহান/ খানজাহান আলী দীঘি) খনন করান। এ সময় অনন্য সাধারণ ধ্যানী বৌদ্ধমূর্তি পাওয়া যায়। ১৯৭১ সালে বৌদ্ধ পুরোহিত বিশুদ্ধানন্দ মহাথেরো পাল আমলে নির্মিত ঐ বৌদ্ধমূর্তিটি কমলাপুর বৌদ্ধ বিহারে সংস্থাপন করেন। যা এ অঞ্চলে বৌদ্ধ প্রভাবের পরিচয় বহন করে। এই বৌদ্ধ মূর্তিটি একটি আবক্ষ (আনন্দিত) মূর্তি।

খলিফাতাবাদ:

          ইতিহাস থেকে জানা যায়, সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহ এর রাজত্বকালে(১৪৪১-১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ)  খান জাহান (রহ:), উলুঘ খান-ই-জাহান পদবিধারী এক জন মুসলিম সেনানায়ক এ শহরের প্রতিষ্ঠা করেন। খ্রিস্টীয় পনের শতকের দিকে বাগেরহাট শহর সংলগ্ন পশ্চিম অংশে এই মুসলিম শহর গড়ে উঠেছিল। এর তথ্য প্রমাণ হিসেবে পর্যাপ্ত উপকরণ আজও বিচ্ছিন্নভাবে বাগেরহাট শহর ও এর আশপাশে ছড়িয়ে আছে।

Shat Gambuj Mosque
Shat Gambuj Mosque

খান-উল-আযম উলুঘ খানজাহানের কবরের পাসের শিলালিপি থেকে জানা যায়, তার মৃত্যুতারিখ ১৪৫৯ খ্রিস্টাব্দ। তিনি তার শহরকে দরবার হল (ষাটগম্বুজ মসজিদ), মসজিদ, আবাসিক ভবন, রাস্তাঘাট দিয়ে সজ্জিত করেন এবং এলাকার মানুষের সুপেয় পানির জন্য বহু দীঘি খনন করেন। ইতিহাসবিদদের ধারণা, সেই শহরের নাম ছিল খলিফাতাবাদ অর্থাৎ খলিফার শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত শহর। ধারণা করা হয় খলিফাতাবাদ শব্দটির আসে খলিফা বা খিলাফাত শব্দ থেকে। মধ্যযুগীয় খলিফাতাবাদ আজ বিলুপ্তপ্রায়। এর অধিকাংশ নিদর্শন গুলো বিগত শতকের গোড়ার দিকে ধ্বংস হয়ে গেছে হয়েছে।বর্তমানে টিকে থাকা স্থাপনাগুলোর মধ্যে মুঘলক স্থাপত্যের প্রভাব বিদ্যমান।

ইতিহাসবিদদের মতে, খ্রিস্টিয় পনের শতকের দিকে ভৈরব নদীর উত্তরদিক থেকে এসে বর্তমানে সুন্দরঘোনা গ্রামের উত্তর-পূর্ব কোণে হঠাৎ বাঁক নিয়ে মগরা, রণবিজয়পুর, কৃষ্ণনগর প্রভৃতি গ্রামের মধ্যদিয়ে এঁকে বেঁকে পূর্বদিকে প্রবাহিত হতো। এর তীর ঘেঁষে আনুমানিক ৬.৫ কিলোমিটার (পূর্ব-পশ্চিম) এবং পাশাপাশি ৩.৫ কিলোমিটার (উত্তর-দক্ষিণ) বিস্তৃত একটি শহর গড়ে উঠেছিল। গবেষকদের মতে এই শহর মধ্যযুগে খলিফাতাবাদ এবং হাবেলীকসবা নামে পরিচিত ছিল। বর্তমানে এর উত্তরে মগরা খাল ও কাড়াপাড়ার বিল, দক্ষিণে ঘুঘুখালির বিল, পূর্বে দড়াটানা নদী ও পশ্চিমে সায়েরা গ্রামের ভুটিয়ামারি পর্যন্ত এসব নিদর্শনাদি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। বেশিরভাগ নির্দশনাদির সন্ধান পাওয়া গেছে সুন্দরঘোনা, সোনাতলা, রণবিজয়পুর, মগরা, কাড়াপাড়া, বাসাবাটি, দশানি, কৃষ্ণনগর, কাঁঠালতলা, বাতামতলা, মগরা গ্রামে।

যেভাবে বাগেরহাট নাম করণ:

          এক সময় বাগেরহাটের নাম ছিল খলিফাতাবাদ বা প্রতিনিধির শহর। খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান গৌড়ের সুলতানদের প্রতিনিধি হিসেবে এ অঞ্চল শাসন করতেন। কেউ কেউ মনে করেন, বরিশালের শাসক আগা বাকেরের নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে। কেউবা মনে করেন, পাঠান জায়গীরদার বাকির খাঁর নামানুসারে বাগেরহাট হয়েছে। আবার কারও মতে বাঘ শব্দ থেকে বাগেরহাট নামটি। জনশ্রুতি রয়েছে, খান জাহান (রহ:)এর একটি বাগ (ফার্সি শব্দ যার অর্থ-বাগান) বা বাগিচা ছিল। এ বাগ শব্দ থেকে বাগেরহাট হয়েছে। আবার কারও কারও মতে নদীর বাঁকে হাট বসত বিধায় বাঁকেরহাট থেকে বাগেরহাট হয়েছে। প্রকৃত ইতিহাস আজও রহস্যাবৃত।

জেলা হিসেবে:

বাগেরহাট জেলার মানচিত্র
বাগেরহাট জেলার মানচিত্র

          ১৮৪২ সালে বাগেরহাট খুলনা মহকুমার অন্তর্গত একটি থানা ছিল। ১৮৬৩ সালে বাগেরহাট যশোর জেলার অন্তর্গত একটি মহকুমায় রূপান্তরিত হয়। আর বাগেরহাট জেলা হিসেবে উন্নীত হয় ১৯৮৪ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী।

বাগেরহাট জেলা সাধারণ তথ্যঃ

       বাগেরহাটের জেলার মোট ৯টি উপজেলা। বাগেরহাট সদর, কচুয়া, ফকিরহাট, মোল্লাহাট, চিতলমারি, রামপাল, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ ও শরণখোলা।

  • অবস্থান :২২°- ৩২¢ থেকে ২২°- ৫৬¢ উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৯°- ৩২¢ থেকে ৮৯°- ৪৮¢ পূর্ব দ্রাঘিমাংশ
  • আয়তন: ৩,৯৫৯.১১ বর্গকিলোমিটার।
  • পৌরসভা: ৩টি। বাগেরহাট পৌরসভা(বাগেরহাট সদর), মোংলা পোর্ট পৌরসভা(মোংলা) এবং মোড়েলগঞ্জ পৌরসভা(মোড়েলগঞ্জ)
  • জেলায় মোট ইউনিয়নের: সংখ্যা ৭৫টি।
  • গ্রামের সংখ্যা : ১,০৪৭ টি।
  • নদ-নদী সংখ্যা: ৩২ টি।

অন্যতম দর্শনীয়স্থানঃ

          সুন্দরবন, করমজল, কটকা, হাড়বাড়িয়া, হিরণ পয়েন্ট, দুবলার চর, খান জাহান (রহ:)-এর দিঘী ও মাজার, ঐতিহাসিক ষাটগুম্বজ মসজিদ, সিংগাইর মসজিদ/এক গম্বুজ মসজিদ, দরিয়া খাঁ’র মসজিদ, খানজাহানের বসতভিটা/টিবি, নয়গম্বুজ মসজিদ, সাবেকডাঙ্গা পূরাকীর্তি, অযোধ্যা মঠ বা কোদলা মঠ, বাগেরহাট জাদুঘর, মোংলা পোর্ট, সেন্ট পলস্ মিশন, মোরেল সাহেবদের নীলকুঠি/মোরেলগঞ্জের কুঠিবাড়ি প্রভৃতি।

Support Context:
  • বাংলাদেশ প্রত্নতত্ব অধিদপ্তর
  • বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন
  • উইকিপিডিয়া

About Inzamamul Haque