প্রচ্ছদ / লেখালেখি / ভ্রমণ / আমাদের মফস্বল শহর ‘বাগেরহাট’

আমাদের মফস্বল শহর ‘বাগেরহাট’

• মাসুমা রুনা

bagerhat-shatgumboj-muskবাগেরহাটের নাম বাইরের কেউ শুনলে প্রথমেই বলে ষাটগম্বুজ মসজিদের কথা। ‘ও আপনাদের ওখানে তো ষাটগম্বুজ মসজিদ’। ‘আমি গিয়েছি, আপনাদের বাড়ি থেকে ষাটগম্বুজ মসজিদ কতদুর…’ ইত্যাদি। অর্থাৎ সবই ষাটগম্বুজ কেন্দ্র করে।

আমি মাথা নেড়ে নেড়ে বলি হু হু বাড়ি থেকে কাছেই। এতটা দূর হবে… এত টাকা রিক্সা ভাড়া। কিন্তু শুধু ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদই নয়, বাগেরহাট সম্পর্কে আমার আরও কিছু বলতে ইচ্ছে হয় বিশেষ করে ঢাকার মত বড় শহর বা অন্য শহরে যাদের জন্ম।

এক কথায় চমৎকার ঘন সবুজ শহর। এক একটা বাড়ি ঢুকতে আশির্বাদ জানাবে মাথা উঁচু করে থাকা বয়সী বৃক্ষের ছায়া। কিছুটা সময় তো আপনার যাবেই এতসব গাছগাছালির নাম জানার ইচ্ছে থেকে। দালানকোঠা, প্রাচীর, বেড়া, টিনের ঘর, গোলের ঘর সব কিছুই পুরোনো। টিনের চালে জং আর দালানকোঠার রঙ ফিকে হয়ে শ্যাওলা ধরা, এগুলো কমন। তবে, আমি বলবো এটা আভিজাত্যেরই প্রতিক। প্রাচীন আভিজাত্য।

কাক হোক আর শালিক হোক গাছের ডালে থাকবেই। বাড়ীর উঠোনে দুইটা কুকুর দেখেশুনে রোদেই শুয়ে থাকে অলস ভঙ্গিমায়। বাড়িতে কেউ আছে কি নেই বুঝতে হলে বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হতে পারে যদি ঠিক দুপুরেই পৌঁছে যান। কারণ মা যে তখন রান্না ঘরে, মশল্লা আর কাঠের চুলার ধোঁয়া সামলাতে বেশ ব্যাস্ত।

Govt-PC-College-Bagerhatবিকেলে রিকশা করে পুরো শহর ঘুরতে গেলে একবারে দুই ঘন্টা চুক্তিতে উঠে পড়লেই হয়! ছোট্ট শহর! দেখা হয়ে যাবে এটুকু সময়েই।

আমি বলবো, পিসি কলেজ-এর ওদিকেই আগে যেতে। দারুন সুন্দর শাপলা ফুলের সাথে কিছু সময় কাটুক শান বাধানো শতবর্ষী পুকুর ঘাটে।

এরপর হরিনখানা থেকে কৃষ্ণনগরের ঘন গাছগাছালি ঘেরা রাস্তা ধরে যেতে পারেন হাড়িখালি’র দিকে। ওই দিকে পালপাড়া আছে। সেখানে কপালে সিদুর আর হাতে কাঁদা মাখা বৌটা তার নিজ হাতে তৈরী করা মাটির কলস, ঠিলা, হাড়ি, পুতুল সাজিয়ে রেখেছে থরে থরে। গোয়াল ঘর আর ঘাস কুটার গন্ধে গ্রামের আমেজ বিদ্যমান!

এরপর ‘কবিখোলা’র ওদিক থেকে সোজা চলে যাবেন নদীর পাড়ের রাস্তা টায়!!

ভৈরবের বুক থেকে বাগেরহাট শহর।
ভৈরবের বুক থেকে বাগেরহাট শহর।

বাগেরহাটের ভৈরব নদ। আমাদের নদী। ওপারের বাড়ীগুলো দেখা যায়, নদীর মাঝে জেলেদের বেঁধে রাখা নৌকাগুলো দেখা যাবে….আর, নদীর বহমান ধারার কিছু না বলা কথা!!

মুনিগঞ্জ ঘাট এর ব্যাস্ততা পার হয়ে ‘পুরোন বাজার’ এরপর ডাকবাংলার মোড় থেকে লঞ্চঘাট, পুরাতন কোর্ট চত্তর, রাহাত হোটেলের মোড় এই জায়গাগুলো বাগেরহাটের শত বছরের পুরোনো আমেজকে ধরে রেখেছে! লঞ্চঘাটের হোটেলগুলোতে কত বছরের পুরোনো চুলায় কত দিন ধরে অভিজ্ঞ কর্মচারী তন্দুরি রুটি, পরোটা, বুন্দিয়া বানায় আমি হিসেব করে বলতে পারবো না!

রাহাতের মোড় থেকে বাজার মেইন রোড। জামাকাপড়, বইখাতা, শাড়ী, গামছা লুঙ্গি, লেপ তোষক এর গাদাগাদি পাশাপাশি দোকান। কোন কোন দোকানগুলোর দোতালায় বাড়ী.. লোহার রেলিঙ ওয়ালা ঝুল বারান্দায় পাতাবাহারের টব।

বাজারের এক এক রাস্তা এক এক নাম। কাপড় পট্টি, গামছা পট্টি, ফল পট্টি। রিয়াজুদ্দিন মার্কেটের গলিতে ‘ন্যায্য মুল্য’ নামে এক দোকান আছে। সেখানে ছোটবেলায় আম্মার সাথে যখন যেতাম, তখন দেখেছিলাম দেয়ালে পেইন্ট করে লেখা “গজের চেয়ে মিটারে কাপড় বেশী” আর ওই দোকানের বাইরে বসে এক লোক তার পায়ে চালিত মেশিন এক মনে ভিষন ব্যাস্ততায় সেলাই করে যেত।

cloud-imageআমার সবচেয়ে ভালো লাগে বাজারের কাপড় পট্টি আর গামছা পট্টির জায়গা টা। চারপাশে পুরোনো দালান। সেই সব স্টুডিও গুলো আর মাঝের আঙিনায় চৌকি পেতে পেতে বসা গামছার দোকান। পাশেই বড় একটা মন্দির। পুরো চত্বর জুড়ে ধুপ আগোর বাতির গন্ধ! এখানে সন্ধ্যে বেলায় এক দোকানে বসলে দেখবেন হিন্দু দোকানিদের চন্দন এর ফোটা পড়িয়ে দিয়ে যায় কেউ যার হাতে একটা পিতলের ঘটি। 

বাজার ঘুরে যেতে পারেন নাগেরবাজার। যেতে যেতে গুড়, বাতাসা, তামাক, সুপারি র গন্ধ, নারকেল এর মিল থেকে আসা নারকেল তেলের মিষ্টি গন্ধ!!! এরপর রিকশা নিয়ে নদীর পাড় ধরে দড়াটানা ব্রিজের দিকে যেতে, বামে নদী আর ডানে মাছ বাজার। শত শত কাকের কা কা রবে মুখোরিত আমাদের মাইছো বাজার!! ঘের এ যে শুধু গলদা আর বাগদা চিংড়িই হয় তা নয় সেখানে আরও বহুপ্রকার মাছ চাষ হয়। বাজারটা ঢুঁ মেরে আসলেই তা বোঝা যাবে। এবার চলে যান দড়াটানা ব্রিজ। দুপাশে অবারিত সবুজ।। ধুন্দুমার!! কি ব্যাপক!! কি দিগন্তজোড়া বিস্তৃত সবুজের হাতছানি!!

ওখান থেকে ফেরত আসার পথে খারদ্বার ,বাসাবাটির ঘন গাছপালার মধ্যে বাড়িঘর-এর পথ পেরিয়ে মিঠা পুকুর পাড়। কি বিশাল এক পুকুর ! পানিতে থৈ থৈ এরপর আমার ফেলে আসা স্কুল … বাগেরহাট গার্লস স্কুল , উচু দেয়ালে ঘেরা কত পুরাতন হাসাহাসি …খিলখিল !! কান পাতলে শোণা যায় আজও। আমাদের স্কুলের রাস্তার অন্য পাশেই জেলখানা। সেখানেও উচু প্রাচীর। কেমন জানি লাগত …ভয় ভয় !

আমি বলবো, ‘আমলা পাড়া’র বাড়ী গুলো সবচে আধুনিক। আর বেশ গোছানো।

আমার বেড়ে ওঠা সরুই মাদ্রাসা রোড । এখানে কত কত স্মৃতি ! একিভাবে যাপিত জীবন গুলো আজও একিরকম এখানে।

বাগেরহাট-এর সবখানে।

সমগ্র বাগেরহাট জুড়েই আসলে সবুজের নেশা । বাতাসে বাতাসে চেনা চেনা সুবাস !!!!

Writer-Runa-Photoলেখক: কবি, লেখক ও ফটোগ্রাফার
স্বত্ব ও দায় লেখকের…
এসআইএইচ/বিআই/১৫ ডিসেম্বর, ২০১৬

About মাসুমা রুনা